প্রান্ত রনি, স্পেশাল করেসপনডেন্ট
রাঙামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মৎস্য ভান্ডার হিসাবে পরিচিত কাপ্তাই হ্রদ। রাঙামাটির আট ও খাগড়াছড়ির দুই উপজেলা মিলে বিস্তীর্ণ ৭২৫ বর্গ কিলোমিটারের কাপ্তাই হ্রদ। ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীতে দেশের প্রথম জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাঁধ দেয়ায় গড়ে ওঠে কাপ্তাই হ্রদ। পরবর্তীতে বৃহৎ বদ্ধ জলাশয় কাপ্তাই হ্রদ পরিণত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় মৎস্য ভান্ডারে। যদিও দিনে-দিনে জৌলুস হারিয়েছে কাপ্তাই হ্রদ। হ্রদের তলদেশে পলি জমে নাব্য সংকট, কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননে ভাটার পাশাপাশি মাছের উৎপাদন কমে এসেছে।
বিগত ৩ মৌসুম ধরে আশঙ্কাজনকহারে কমছে মাছের উৎপাদন। এজন্য মৎস্যজীবী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রজননকেন্দ্র ধ্বংস, জলবায়ুজনিত কারণে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাব ও হ্রদে পানিস্বল্পতাকে দুষছেন। এদিকে, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির সাতটি চেকপোস্ট দিয়ে অবৈধভাবে মাছ পাচার করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে- বলে সতর্ক করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছে কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্রকে।
কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে (২০২২-২৩ অর্থবছর) কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৫ হাজার ৪৯০ টনের অধিক মাছ অবতরণ করা হয়েছে; এর বিপরীতে বিএফডিসির রাজস্ব আদায় হয়েছে ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা। গত ২০২১-২২ মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদ থেকে ৬ হাজার ৫২৩ টনের অধিক মাছ অবতরণ করা হয়েছে; এর বিপরীতে বিএফডিসির রাজস্ব আদায় হয়েছে ১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২০-২১ মৌসুমে ৬ হাজার ৭৯৪ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১২ কোটি ১৩ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এর আগের ২০১৯-২০ মৌসুমে ৮ হাজার ৫৬২ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ; ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৮ হাজার ৪৫৭ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১২ কোটি ৭৮ লাখ; ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৮ হাজার ১১৪ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১২ কোটি ৪২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
বিপণনকেন্দ্রের মৎস্য অবতরণের বার্ষিক হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে ২০১৯-২০ মৌসুম পর্যন্ত তিন মৌসুমে মাছ অবতরণ ও রাজস্ব আদায় বেড়েছে। ২০২০-২১ মৌসুমে অবতরণ ও রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। এক মৌসুমের ব্যবধানে অবতরণ কমেছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ টন। ২০২১-২২ মৌসুমে অবতরণ কমেছে ২ হাজার টনের অধিক। ২০২২-২৩ মৌসুমে অবতরণ কমেছে আরও ৩ হাজার টনেরও বেশি। প্রজাতিভিত্তিক মাছ অনুযায়ী, অবতরণকৃত বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে আগের মতো কেঁচকি, চাপিলা ও মলাসহ দেশীয় প্রজাতির মাছের আধিক্য বেশি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিপণনকেন্দ্রের মার্কেন্টিং অফিসার কাজী মঞ্জুরুল আলম শিজক ডটকমকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে ৫ হাজার ৪৯০ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১১ কোটি ২০ লাখ রাজস্ব আদায় হয়েছে। বিগত মৌসুমের তুলনায় এবার উৎপাদন ও রাজস্ব আয় দুটোই কমেছে। তবে এবার কাপ্তাই হ্রদে পানি কম থাকার কারণে উৎপাদন অনেক কম হয়েছে। পানিস্বল্পতার কারণে এবার নির্ধারিত সময়ের ১১দিন আগেই মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়া হয়।’
এদিকে, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বিএফডিসি এক চিঠিতে কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্রেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বার্ষিক আয় অর্জনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল। বিএফডিসির হিসাবনিয়ন্ত্রক মো. রাজিবুল আলমের সই করা সেই চিঠিতে বলা হয়, কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্র্র রাঙামাটিকেন্দ্রের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২২ মাসের আয়-ব্যয় প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় কেন্দ্রের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ কোটি সাড়ে ৬৭ লাখ টাকার বিপরীতে প্রথম ৬ মাসে কেন্দ্রে রাজস্ব আয় হয়েছে ৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা মাত্র। যা বার্ষিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ৪৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ অর্জন মাত্র। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব অর্জন তুলনামূলক অনেক কম।
অপরদিকে, কেন্দ্রের একইসময়ে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি টাকা। যার ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত কেন্দ্রের অপারেশনাল লাভ হয়েছে ৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা মাত্র। ২০২২-২০১৩ অর্থবছরে কেন্দ্রের বার্ষিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযাযী রাজস্ব আয় অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে ওই চিঠিতে। যদিও মৌসুম শেষে দেখা যায়, বার্ষিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ কোটি সাড়ে ৬৭ লাখ টাকা থাকলেও রাজস্ব আদায় হয়েছে কেবল ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা। অবতরণের ক্ষেত্রে ৯ হাজার টন মাছ অবতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৫ হাজার ৪৯০ টন।
অন্যদিকে, মাছের উৎপাদন কমার পেছনে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মাছ পাচারের পুরনো অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বিএফডিসির এক সর্তক বার্তায়। এক চিঠিতে বিএফডিসির সাতটি চেক পয়েন্টে নজরদারিতে গাভিলতির কথা উল্লেখ করা হয়।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বিএফডিসির ক্রয় ও বিপণন শাখার পরিচালক অদ্বৈত চন্দ্র দাসের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্রের আয় ক্রমান্বয়ে আশঙ্কাজনকহারে হ্রাস পাচ্ছে। রাঙামাটিকেন্দ্রের মানিকছড়ি, জিরোমাইল, জামতলী, জালিয়াপাড়া, চিৎমরম, মেরুং ও বড়ইছড়ি- এই সাতটি চেকপোস্টে পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে কাপ্তাই হ্রদ হতে আহরিত মাছ নির্ধারিত অবতরণ কেন্দ্রে অবতরণ না করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মাছ যেন অন্যত্র চলে না যায় সে ব্যাপারে নজরদারি বৃদ্ধিসহ অধিকতর সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় ওই চিঠিতে।
মাছের রাজস্ব ফাঁকি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক কমান্ডার মো. আশরাফুল আলম ভূঁইয়া শিজক ডটকমকে বলেন, ‘রাজস্ব ফাঁকি মাছ পাচারের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। বিএফডিসির যে সাতটি চেকপোস্ট রয়েছে; সেগুলো ফাঁকি দিয়ে মাছ পাচারের খুব বেশি সুযোগ নেই। কারণ জায়গায় আমাদের নিজস্ব চেকপোস্ট ও অন্যান্য সংস্থারও চেকপোস্ট রয়েছে। সবকিছু ফাঁকি দেয়া এত সহজ হবে না।’
প্রধান কার্যালয়ের সতর্ক বার্তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসের যে সতর্ক বার্তার কথা বলছেন, সেটি আমার জানা নেই। তখন আমি এখানে যোগদান করিনি।’
উল্লেখ্য, প্রতি বছরের ১ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিনমাস হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন ও অবমুক্ত করা পোনা মাছের সুষম বৃদ্ধি নিশ্চিত করাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে আগস্ট থেকে শুরু হয় মাছ আহরণের নতুন মৌসুম; যা শেষ হয় পরবর্তী বছরের এপ্রিলে। তবে পানিস্বল্পতার কারণে ২০২১-২২ মৌসুমে এক মাস দেরিতে মাছ আহরণ শুরু হয়। এর আগে, ২০২০-২১ মৌসুমেও একই কারণে ১০ দিন দেরিতে মাছ আহরণ শুরু হয়। চলতি মৌসুমে ১১ দিন আগে অর্থাৎ ২০ এপ্রিল থেকেই বন্ধ হয় মাছ শিকার। যদিও হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না বাড়লে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা গেলো দুই মৌসুমের মতো বাড়তে পারে।
সরকারি হিসাবে রাঙামাটির আট উপজেলা ও খাগড়াছড়ির দুই উপজেলা নিয়ে কাপ্তাই হ্রদ নির্ভরশীল সাড়ে ২৬ হাজার নিবন্ধিত জেলে পরিবার রয়েছে। কিন্তু গতবছর সাড়ে ২৫ হাজার নিবন্ধিত জেলের তালিকা থাকলেও এবার আরও ১ হাজার বেড়েছে।