রবিবার, নভেম্বর ১০, ২০২৪

চট্টগ্রামের ৫ জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বেইলির বদলে হবে আরসিসি-পিসি গার্ডার সেতু

প্রান্ত রনি, শিজক রিপোর্ট
রাঙামাটি: বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই পাঁচ জেলায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং আঞ্চলিক সড়কগুলোতে বেইলি সেতু নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। তবে দীর্ঘকাল আগে বসানো এসব বেইলি সেতুর বেশিরভাগই অপ্রশস্ত ও জরাজীর্ণ। যে কারণে বিভিন্ন সময়েই হারহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনায়।

বিগত কয়েকবছরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বেইলি সেতু ধসে হতাহতের ঘটনার পাশাপাশি বন্ধ হয়ে পড়েছিল আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে এই বেহালদশার উত্তরণে দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ জেলায় বেইলি সেতুর স্থলে আরসিসি গার্ডার ও পিসি গার্ডারসহ নান্দনিক সেতু প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সওজ। ইতোমধ্যে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সওজ।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, প্রস্তাবিত ডিপিপিতে চট্টগ্রাম বিভাগের ৫ জেলায় সওজ চট্টগ্রাম জোনের আওতাধীন ৬টি সড়ক বিভাগের মাধ্যমে ৩৫টি আঞ্চলিক মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও অভ্যন্তরীণ সড়কে জরাজীর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ), অপ্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিদ্যমান ১০৫ বেইলি ও ৮টি আরসিসি সেতু প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে বেইলি সেতুসহ অন্যান্য সেতু প্রতিস্থাপনের ফলে সড়ক নেটওয়ার্কের মানোন্নয়ন, জনসাধারণের নিরাপত্তা, সময় ও ব্যয় সাশ্রয় হবে। তবে তিন পার্বত্য জেলায় ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্য যে ১০টি বেইলি সেতু রয়েছে; সেগুলো পর্যটনবান্ধব হিসাবে নান্দনিকভাবে স্টিল সেতু করা হবে।

সর্বশেষ গত ৭ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় মাইনি নদীর ওপর নির্মিত বেইলি সেতুটি পাথরবোঝাই ট্রাকসহ ধসে পড়ে। এতে খাগড়াছড়ির সঙ্গে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা ও সাজেক পর্যটন উপত্যকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘের এই সেতুটি রয়েছে নান্দনিক নকশার সেতুর তালিকায়।

এছাড়া ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি রাঙামাটি সদর ও নানিয়ারচরের সীমান্ত কুতুকছড়ি বাজারের বেইলি সেতু ধসে ট্রাকচালক, সহকারীসহ তিনজন নিহত হয়। এ ঘটনার পর রাঙ্গামাটির সঙ্গে তাৎক্ষনিক খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির রাজস্থলীর বাঙালহালিয়ায় একটি বেইলি সেতু ভেঙে রাঙ্গামাটির সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে।

২১ আগস্ট রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার পোয়াপাড়ায় অবস্থিত বেইলি সেতুটি ধসে পড়ে। এতে করে উপজেলা সদরের সঙ্গে নাইল্যাছড়ির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর খাগড়ছড়ির দীঘিনালার বোয়ালখালী চৌমুহনীতে বেইলি সেতু ধসে দীঘিনালা উপজেলার সঙ্গে মেরুং ইউনিয়ন ও রাঙামাটির লংগদু উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয় এবং তিনজন আহত হন।

এর আগে, ২০১৮ সালের ১ আগস্ট বান্দরবানে বেইলি সেতু ভেঙে রুমা ও থানচি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। তিন পার্বত্য জেলার এমন অসংখ্য বেইলি সেতু ধসে হতাহত ও সড়ক যোগযোগ বন্ধের ঘটনা বিগত এক দশকে ঘটেছে। এতে করে অনিরাপদ হয়ে মরণফাঁদে পরিণত হয় পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক সড়ক।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ‘গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জরাজীর্ণ ও অপ্রশস্ত বিদ্যমান বেইলি সেতু/আরসিসি সেতু প্রতিস্থাপন প্রকল্পে’র অধীনে চট্টগ্রাম বিভাগের ৫ জেলায় ৯৫টি পিসি গার্ডার সেতু, ১৮টি আরসিসি সেতু ও ৯টি বক্স কালভার্ট নির্মিত হবে। তন্মধ্যে ৪ হাজার ৪৫৫ দশমিক ৬৩ মিটার পিসি গার্ডার, ৩৪৮ দশমিক ১২ মিটার আরসিসি গার্ডার ও ৬৯ দশমিক ৬৫ মিটার আরসিসি বক্স কালভার্ট করা হবে।

প্রকল্পে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের অধীনে ৮টি পিসি গার্ডার সেতু। দোহাজারী সড়ক বিভাগের অধীনে ৮টি পিসি গার্ডার ও ১টি আরসিসি গার্ডার সেতু। কক্সবাজার সড়ক বিভাগের অধীনে ১০টি পিসি গার্ডার ও ২টি আরসিসি গার্ডার সেতু। রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের অধীনে ১১টি পিসি গার্ডার, ১টি আরসিসি গার্ডার এবং ১টি আরসিসি বক্স কালভার্ট। খাগড়াছড়ি সড়ক বিভাগের অধীনে ৯টি পিসি গার্ডার ও ৮টি আরসিসি বক্স কালভার্ট এবং বান্দরবান সড়ক বিভাগের অধীনে ৪৯টি পিসি গার্ডার ও ১৪টি আরসিসি গার্ডার সেতুর প্রস্তাব করা হয়েছে।

মূলত প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ হচ্ছে পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের প্রাক্কলিক ব্যয় প্রায় ১৬০০ কোটি ধরা হলেও চূড়ান্ত ডিপিপি অনুমোদনে প্রকল্প ব্যয় আরও বাড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর রাঙামাটি বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আলনূর সালেহীন জানান, ‘সওজ’র একটি জোনাল প্রকল্পে চট্টগ্রাম জোনের ৬টি সড়ক বিভাগের অধীনে ৫ জেলায় ১০৫টি বেইলি সেতু ও ৮টি আরসিসি সেতু প্রতিস্থাপনের মেগাপ্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে বেইলি থেকে আরসিসি গার্ডার ও পিসি গার্ডার সেতু প্রতিস্থাপনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হচ্ছে। চূড়ান্ত রিপোর্টের পর প্রকল্পটি পাস হলে ৫ জেলায় নিরাপদ সড়ক উন্নয়নে কাজ শুরু হবে। প্রকল্পটির অধীনে তিন পার্বত্য জেলার ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্য ১০টি বেইলি সেতুকে পর্যটনবান্ধব নান্দনিক নকশায় করা হবে।’

সওজ বান্দরবান বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, সওজের ব্রিজ ম্যানেজমেন্ট উইং আমাদের প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) সম্ভাব্যতা যাচাই ও আধুনিক নকশার কাজ করছে। যেটি বর্তমানে শেষ পর্যায়ে। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে পুরনো নকশায় আমরা প্রাক্কলিক তৈরি করেছি, তবে এখন বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। কিছু সেতু নান্দনিক নকশায় হবে। কাজ শেষে চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা পুনরায় ডিপিপি পাঠাব, তখন প্রকল্পটি পাস হলে কার্যক্রম শুরু হবে।’

এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সুদৃড় হবে বলে মনে করেন প্রস্তাবিত প্রকল্পে সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা এই প্রকৌশলী।

সম্পর্কিত খবর

সোশ্যাল মিডিয়া

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর