প্রান্ত রনি, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
রাঙামাটি: নিজ বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে আসামি হন রাঙামাটির লংগদু উপজেলার করল্যাছড়ি আরএস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রহিম (৪৬)। সেই মামলায় ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর আব্দুর রহিমকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন রাঙামাটির নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত।
এই মামলায় সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে ভিকটিমকে এক একর জমি লিখে দেওয়ার শর্তে ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আব্দুর রহিম তিন মাসের জামিন নেয়। দুই মাসের মধ্যে ভিকটিমকে এই এক একর জমি হস্তান্তর করতে বলেছেন আদালত। তবে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে বহাল থাকার সুযোগ না থাকলেও নিয়ম ভেঙে বহাল তবিয়তে রয়েছেন প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম। গত ২১ জুন কারামুক্তির পর ২৩ জুন বিদ্যালয়ে যোগদান করে রহিম। এরপর থেকে বিদ্যালয়ে নিয়মিত যাচ্ছেন তিনি।
জেলা শিক্ষা অফিস বলছে, ২০২০ সালে গ্রেফতার ও ২০২২ সালে যাবজ্জীবন সাজা হলেও শিক্ষা অফিসকে এখনো পর্যন্ত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো অবগত করেনি। আর আব্দুর রহিমের চাকরি বর্তমানে কিভাবে রয়েছে এসব বিষয়ে কিছুই জানে না প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষা অফিস জানিয়েছে, শিক্ষক নিয়োগ-বরখাস্ত থেকে শুরু কর্তৃত্বের বিষয়ে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির কাছেই পূর্ণ দায়িত্বভার রয়েছে।
সরকারি চাকরি আইনের বিধিমালা ৪২ এর (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড বা এক বছর মেয়াদের অধিক মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে দণ্ড আরোপের রায় বা আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে চাকরি তাৎক্ষনিকভাবে বরখাস্ত হবেন।
আরও পড়ুন: এক একর জমি লিখে দেওয়ার শর্তে ধর্ষকের জামিন
রাঙামাটি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মৃদুল কান্তি তালকুদার বলেন, ‘লংগদুর করল্যাছড়ি আরএস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিমের ধর্ষণ মামলায় সাজার বিষয়টি শুনেছি। তবে এই ব্যাপারে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি আমাদের কোনো প্রকার অবগত করেনি। সেক্ষেত্রে আব্দুর রহিম এখনো প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন নাকি বরখাস্ত আছেন এসব বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। সাধারণত এমপিওভুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নিয়োগ থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয়গুলো বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিই করে থাকে। সেক্ষেত্রে আব্দুর রহিমের বিষয়ে তারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটি আমাদের জানা নেই। ঘটনার পর এখনো পর্যন্ত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই জানায়নি। তবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কেউ যদি এই ধরণের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হন সেক্ষেত্রে চাকরিতে বরখাস্ত হওয়ারই কথা।’
এদিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে করল্যাছড়ি আর এস উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি জিয়াউর রহমান বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহিম জুন মাসের ২৩ তারিখে বিদ্যালয়ে যোগদান করেছে এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসছেন। ধর্ষণ মামলার রায় হওয়ার আগে আব্দুর রহিম ২২ মাসের অর্জিত ছুটির আবেদন করেন। অর্জিত ছুটি থাকাকালীন অবস্থায় তো উনার চাকরি যায় না, যেহেতু ছুটি আছে। এরপর আদালত কর্তৃকও রায়ের পর তার চাকরি থাকবে না কিংবা তাকে সাসপেন্ড করতে হবে এমন কোনো আদেশ আমাদের দেয়নি। যার কারণে তিনি যখন হাইকোর্টে আপিল করেছেন তখন আমাদের আপিলের একটি কপি দিয়েছেন। হাইকোর্টের আপিলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আমরা কমিটি ছিলাম। এরপরও যদি উনার জামিন না হতো সেক্ষেত্রে আমরা ম্যানেজিং কমিটি নিতাম। পরবর্তীতে তিনি যখন জামিনে আসলেন আবার ছুটিও রয়েছে; তখন উনি আবেদন করেন উনার ছুটি যে ক’মাস বাকী ছিল সে কয়েকমাসের প্রয়োজন নেই। তাই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে তাকে নেয়া হয়েছে।’
অন্তর্বর্তীকালীন তিন মাস জামিনের মেয়াদ যদি বর্ধিত না হয় সেক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটির পরিকল্পনা কী হতে পারে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতি বলেন, ‘পরবর্তীতে তিনি যদি আবার ঢুকে যায় (কারাগার) সেক্ষেত্রে আমরা আর তাকে নেব না। নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর থাকব- এমনটাই পরিকল্পনা রয়েছে।’ তবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রহিমের কোনো বক্তব্য জানতে পারা যায়নি।
রাঙামাটি জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাজীব চাকমা বলেন, ‘কেবল সাজাপ্রাপ্ত হলেই নয়, ফৌজদারি মামলায় কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হলেই সাময়িক বরখাস্ত হবেন। আর অপরাধের সাজা হলে কোনোভাবে চাকরি থাকার সুযোগ নেই। সাজার হওয়ার পরই তাৎক্ষনিকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নিয়ম রয়েছে। কেউ যদি সাজার পাওয়ার পর চাকরিতে বহাল তবিয়তে থাকেন; তাহলে এক্ষেত্রে অবশ্যই আইনের ব্যতয় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগও এ দায় পড়াতে পারেন না।’
রাঙামাটি জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিলেও আসামির সাজা তো বহাল রয়েছে। সেক্ষেত্রে তো চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী তাৎক্ষনিক বরখাস্ত হওয়ার কথা। এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় হলে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি মাউশি বরাবর চিঠি দিলেই তো বরখাস্ত হওয়ার কথা।’
মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির লংগদু উপজেলার করল্যাছড়িতে এক স্কুলছাত্রী (১৬) ছাগল খুঁজতে বের হলে করল্যাছড়ি আর এস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রহিম তাকে লেবু দেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে স্কুলের ছাত্রাবাসে ধর্ষণ করে। সে সময়ে স্কুলের ছাত্রাবাসে কেউ ছিল না। বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকি দিতে থাকেন ওই শিক্ষক। পরবর্তীতে ঘটনার ৯ দিন পর ৫ অক্টোবর স্কুলছাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে লংগদু থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর আব্দুর রহিমকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- দিয়ে রাঙামাটির নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ ই এম ইসমাইল হোসেন রায় দেন। একইসঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামি আব্দুর রহিম। পাশাপাশি তিনি জামিন চেয়েও আবেদন করেন। এরপর গত ৩০ মার্চ এ বিষয়ে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে গত ১ জুন বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে আদেশ যাতে পুনর্বিবেচনা করা যায় সেজন্য বিষয়টি ১৫ দিন পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হয়। ১৫ জুন মামলাটি পুনরায় কার্যতালিকায় আসে। এরপর অধস্তন আদালতের প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর গত ২১ জুন আসামি আব্দুর রহিম রাঙ্গামাটির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
জামিন আদেশে আদালত বলেছেন, মামলার তথ্য ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের আইনজীবীদের দাখিল করা অঙ্গীকারনামার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আব্দুর রহিমকে তিন মাসের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিচ্ছি। জামিনের শর্ত, আপিলকারী আব্দুর রহিম জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে উপরে বর্ণিত হিসাবে (জমি হস্তান্তর করে) একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেবেন। আপিলকারী আসামি উপরোক্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হলে জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না।