বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

দ্বাদশের ভোটে দুই মেরুতে পাহাড়ের ৪ রাজনৈতিক দল

প্রান্ত রনি, শিজক রিপোর্ট
রাঙামাটি: ভৌগোলিকভাবে দেশের প্রায় এক দশমাংশজুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। আয়তনে বড় হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে জনসংখ্যা অনেক কম পাহাড়ের তিন জেলায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা নিয়ে কেবলমাত্র তিনটি সংসদীয় আসন। ২৯৮ নম্বর ঘাগড়াছড়ি, ২৯৯ নম্বর রাঙামাটি এবং ৩০০ নম্বর পার্বত্য বান্দরবান। সারাদেশেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় রাজনৈতিকদলগুলো। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিল ভিন্নতা; পাহাড়ের তিন জেলায় আঞ্চলিক দলগুলো বরাবরই ভোটের মাঠে ‘ফ্যাক্টর’ ছিল। কিন্তু এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলা কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রার্থী নেই। যে কারণে দ্বাদশে ভোটে ‘নিবিঘ্নে জয় পাবে নৌকা’- এমনটাই ভাষ্য স্থানীয়দের।

তবে নির্বাচনের ভোটগ্রহণের আগেই ভোটের ফলাফল অনুমান করে ফেলছেন পাহাড়ের রাজনৈতিক দল ও সাধারণ ভোটাররা। তিন পার্বত্য জেলায় নৌকা তথা আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের ‘প্রতিযোগিতাহীন জয়’ নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই পাহাড়ের আঞ্চলিকদলগুলোর নেতাকর্মীদের। বিবাদমান রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মীরে ভাষ্য হলো, ‘নিয়ম রক্ষার ভোটে’ নৌকাই জিতবে, তবে আনুষ্ঠানিকতার কারণে চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল দুইটি ভিন্নপথ অবস্থান নিয়েছৈ।

ভোটকে ‘নিরুৎসাহিত’ করছে জেএসএস-ইউপিডিএফ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রতিহতের’ ঘোষণা থেকে সরে এসে ভোট ‘বর্জনের’ কথা বলছে দেশের ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ বিএনপি। সারাদেশে বিএনপি ও সমমনাদের ভোট বর্জনের বাহিরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট বর্জন করেছে ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ। প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের এই রাজনৈতিক দলটি ভোট বর্জন করে সাধারণ মানুষকে সাত দফা আহ্বানও জানিয়েছে।

দলটির মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেছেন, ‘সরকারের প্রহসনের নির্বাচনে বেশিরভাগই রাজনৈতিকদলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তারা সাধারণ মানুষকে ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করবেন।’

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে কেবলমাত্র রাঙামাটি আসনে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সমর্থিত প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে ফেলেন। তবে দ্বাদশের ভোট নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য জানায়নি জনসংহতি সমিতি-জেএসএস। দলটির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের মুঠোফোনে কল দিলেও সেটি বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এবারের নির্বাচনে ভোটদান থেকে বিরত থাকবেন দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। যে কারণে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় মূলত ইউপিডিএফ এবং জনসংহতি সমিতির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ভোট না পরার সম্ভাবনাও রয়েছে।

নৌকায় আস্থা রাখল দু’দল
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটে অংশগ্রহণ করে দ্বাদশে এসে দুইটি ‘প্রভাবশালী’ আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস-ইউপিডিএফ ভোটদানে নিরুৎসাহিত করলেও নৌকায় আস্থা রাখলো সর্বশেষ দুইটি প্রতিষ্ঠিত পাহাড়ের অন্য দুইটি আঞ্চলিক দল। সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি ভেঙে গড়ে ওঠা জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ ভেঙে আত্মপ্রকাশ করা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দ্বাদশের ভোটে একাদশের মতো আওয়ামী লীগকেই সমর্থন জানিয়েছে।

ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়েছি। আমরা মনে করছি, আওয়ামী লীগ যদি পুনর্নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে তখন পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন ও পাহাড়ের স্থায়ী প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। সেজন্য আমরা নির্বাচনে নৌকাকে সমর্থন জানিয়েছি।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সহ-সাধারণ সম্পাদক ও বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বলেন, ‘সব নির্বাচনেই আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন তো থাকেই। এবারের নির্বাচনে আমরা প্রত্যক্ষভাবে নৌকার প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছি।’

৩ জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী নয়জন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় মোট ৯ জন প্রার্থী রয়েছেন। খাগড়াছড়িতে চারজন, রাঙামাটিতে তিনজন এবং বান্দরবানে দুইজন। ২৯৮ নম্বর আসনটিতে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছেন চারজন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এবারও নৌকার মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন মিথিলা রোয়াজা, তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন উশেপ্রু মারমা এবং ন্যাশনাল পিপল্স পার্টির আম প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন মোহাম্মদ মোস্তফা।

২৯৯ নম্বর রাঙামাটি আসনটিতে তিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার; তিনি এবারসহ নৌকার মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন সপ্তমবারের মতো। তৃণমূল বিএনপির সোনালী আঁশ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন মো. মিজানুর রহমান এবং বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ছড়ি (লাঠি) প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা অমর কুমার দে।

৩০০ নম্বর আসনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছেন দুইজন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ছয়বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য বীর বাহারদুর উশৈসিং। তিনি এবারসহ সাতবারের মতো নৌকার মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে লড়বেন এটিএম শহিদুল ইসলাম।

ভোটার সাড়ে ১২ লাখ
২ হাজার ৬৯৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে গঠিত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার উপজেলা রয়েছে নয়টি। এই নির্বাচনি আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪১৯ জন। এরমধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৭৩, পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৪ এবং দুইজন হিজড়া ভোটার রয়েছেন।

৬ হাজার ১১৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে গঠিত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা। দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়িসহ রাঙ্গামাটির মোট উপজেলা ১০টি। নির্বাচনি এই আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩৫৪ জন। এরমধ্যে নারী ভোটার ২ লাখ ২৭ হাজার ৩৬, পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪৭ হাজার ৩১৬ এবং হিজড়া ভোটার রয়েছেন দুইজন।

৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে পার্বত্য বান্দরবান জেলা শেষ সংসদীয় আসন। বান্দরবান জেলার আয়তন ৪ হাজার ৪৭৩ বর্গ কিলোমিটার। এই উপজেলায় উপজেলা রয়েছে সাতটি। নির্বাচনি এই আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩০ জন। এরমধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪৪৬, পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৮৪।

অতিদুর্গম ৩৩ ‘হেলিসর্টি’ ভোটকেন্দ্র
খাগড়াছড়ির ১৯৬টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দুর্গম এলাকার তিনটি ভোটকেন্দ্র রয়েছে ‘হেলিসর্টি’ অর্থাৎ এই তিনটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনি সরঞ্জাম ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের যেতে হয় হেলিকপ্টারে করে। তিনটি হেলিসর্টি কেন্দ্রের মধ্যে দুইটি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় দুইটি এবং একটি দীঘিনালায়।

রাঙামাটির ২১৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দুর্গম এলাকার ১৮টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে ‘হেলিসর্টি’। ১৮টি হেলিসর্টি কেন্দ্রের মধ্যে বাঘাইছড়িতে ছয়টি, বরকলে দুইটি, জুরাছড়িতে সাতটি এবং বিলাইছড়ি উপজেলায় তিনটি। বান্দরবানের ১৮২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে দুর্গম এলাকার ১২টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে ‘হেলিসর্টি’। ১২টি হেলিসর্টি কেন্দ্রের মধ্যে রোয়াংছড়িতে একটি, রুমায় তিনটি এবং থানচি উপজেলায় আটটি।

বিভিন্ন নির্বাচনি পাহাড়ের এসব হেলিসর্টি কেন্দ্রে নির্বাচনি সরঞ্জাম ও ভোটগ্রহণ কর্মীদের হেলিকপ্টারযোগে পাঠানো হলো প্রায় সময়ই ফিরে আসতে দুর্গম এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে-সড়ত পথ ধরেই।

তবে এবার রাঙামাটি রির্টানিং অফিসার ও জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানিয়েছেন, ‘১৮টি হেলিসর্টি ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনি সরঞ্জাম ও ভোটগ্রহণ কর্মীদের ৮ জানুয়ারি হেলিকপ্টার যোগেই নিয়ে আসা হবে।’

সম্পর্কিত খবর

সোশ্যাল মিডিয়া

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর