প্রান্ত রনি
ক’দিন আগে বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা, অনলাইনের সংবাদে পড়েছি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় এক শিক্ষককে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে ওই শিক্ষককে খাগড়াছড়ি জেলায় বদলি করা হয়। এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীতেও। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ায় রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের এক ইন্সপেক্টরকেও পার্বত্য চট্টগ্রামে আমর্ড পুলিশ ব্যাটেলিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়। তার মানে কি একাত্তরের মানবতাবিরোধী এক যুদ্ধাপরাধীর প্রতি ‘দরদ’ দেখানোর কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা খাগড়াছড়িতে ‘পানিশমেন্ট’ বদলি? এর মানে কী দাঁড়াইলো পার্বত্য চট্টগ্রাম কি সরকারি কর্মচারি আমলাদের জন্য পানিশমেন্টের জন্য সঠিক জোন? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য শাস্তিমূলক বদলি (পানিশমেন্ট) যদি দিতেই হয় সেক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামই হতে হবে কেন?
শুধু এবারের ঘটনাই নয়; বিভিন্ন সময়েই দেশের বিভিন্ন জেলা, নগরের আলোচিত, সমালোচিত, বিতর্কিত সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলি হিসাবে ট্রান্সফার করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান- এই তিন জেলায়। ইদানিংকালে যে এই ‘পানিশমেন্টের জোনের’ উদ্ভব হয়েছে সেটি কিন্তু নয়। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত আছে, চলছেই। একেবারে দেখে দেখে বেচে বেচে সবচেয়ে বিতর্কিত, কর্মস্থলে অনিয়মকারীদের পাঠানো হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। তার মানে কী দাঁড়াল? বিতর্কিত, নৈতিক স্খলন হওয়াদের শাস্তির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামই উর্বর ভূমি?
মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘর করে দেওয়ার যে মহতি উদ্যোগ সরকার নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসীয় উদ্যোগ। বর্তমান সরকারের এই উদ্যোগে অনেক গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার থাকার ঘর ও জায়গা পেয়েছেন। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়ও পৌঁছে গেছে সরকারের দেয়া এইসব আশ্রয়ণের ঘর। কিন্তু গত বছরে চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে সেখানকার তৎকালীন ইউএনও, এসি ল্যান্ড ও পিআইও’র বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিভাগীয় মামলা খাওয়া সেই দুই কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল রাঙামাটি জেলায়।
বিগত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ ঘেঁটে দেখলে আমরা দেখতে পাই শুধু যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নেওয়া এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, অনিয়মে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন ধরণের বিভাগীয় কাজে তিরস্কৃত ও শাস্তিপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-আমলাদের পাহাড়ে পানিশমেন্টে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বোধগম্য নয় যে রাষ্ট্রের এই ভাবনা কিভাবে আসে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হলে তারা সঠিক পানিশমেন্ট বা শাস্তি পায়? একদিকে অনিয়মকারীদের কথা ভাবলেও তো চলবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব মানুষ বসবাস করেন তাদের সঙ্গে এই ধরণের সরকারি কর্মকর্তারা কেমন আচরণ করছে সেটিও দৃষ্টিভঙ্গিতে রাখা দরকার। নাকি এখানকার পাহাড়ের সাধারণ মানুষেরা বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজেদের ‘খাপখাইয়ে’ নিয়েছেন?
এবার আসি ভালোর কথায়। সরকারের নীর্তিনির্ধারকগণ ও উচ্চপদস্থ আমলারা এখনো যেই এলাকা বা অঞ্চলটিকে ‘পানিশমেন্ট জোন’ হিসাবে দৃষ্টিভঙ্গিকে আটকে রেখেছেন সেখানে অনেক ‘ভালো কর্মকর্তারা’ কাজ করে গেছেন। কেউ কেউ এক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত রুমা, থানচি, বরকল, বিলাইছড়ি, রামগড়ে সরকারি দায়িত্ব পালন করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, করছেন। অনেকের কথা এখনও মনে রেখেছেন পাহাড়ের প্রত্যন্ত উপজেলার বাসিন্দারা। যারা পাহাড়কে ভালোবেসে কাজ করে গেছেন তারা কি সবাই ‘পানিশমেন্টে’ ছিলেন- না সেটি তো অবশ্যই নয়।
‘মানুষ জনপ্রতিনিধিদের কাছে সরাসরি ও সহজে যেতে পারে, মনের ইচ্ছে মতো কথা বলতে পারি; কিন্তু আমলাদের সঙ্গে পারেন না’ এক সময়ে এই প্রবাদ প্রচলিত থাকলেও এখন দৃশ্যত অনেকটা বদলে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে মানুষ স্বচ্ছন্দে যাচ্ছেন এবং সেবাও গ্রহণ করছেন। সাম্প্রতিক সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক উপজেলায় বেশ কয়েকজন ইউএনও দায়িত্ব পালন শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে মানুষকে বিদায় জানিয়েছেন, বিদায় নিয়েছেন। মানুষের সেবায় নিজেকে কতটা উজাড় করে দিলে, আপন করে নিতে পারলে সাধারণ মানুষ একজন কর্মকর্তার বিদায়ে শূন্যতা অনুভব করেন। আবার বিতর্কিতদের যদি পাহাড়ের দিকে পাঠিয়ে দেন তাহলে পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের জন্য কী হবে? কাজের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ, অনিয়মকারী ও মৌলবাদীদের এদিকে ঠেলে দিলে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করবে কারা? বিতর্কিতদের পাহাড়ে পাঠিয়ে পাহাড়ের মানুষকে অবমূল্যায়ন করা, সাদাসিধে ভাবা, বোকা বানানো হচ্ছে না তো?
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি রাষ্ট্রের এই ‘পানিশমেন্ট জোন’ দৃষ্টিভঙ্গি কি মানুষের কাজ করে যাওয়া কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হয়ে যায় না? যারা ভালোভাবে দায়িত্বপালন করেছেন, যারা থেকেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে। পাহাড়ের কৃষির উন্নয়নে, রাস্তাঘাটের উন্নয়নে, শিক্ষার উন্নয়নে, গ্রামীন জনগোষ্ঠীসহ সমগ্র আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। হ্যাঁ, প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে পানিশমেন্ট ট্রান্সফার কোথায় দেয়া যেতে পারে; সেটি নিয়ে ভাবুন। পানিশমেন্ট দিয়ে বদলির জন্য দেশের অনেক জায়গা আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। সব ‘অপরাধী’কে পাহাড়ে এনে রাখতে হবে কেন?
পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের জীবন মানোন্নয়নে দীর্ঘদিনের পঁচা-গলা এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতেই হবে। পাহাড়ের মানুষ এখনো অনেক সহজ-সরল। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ টেকসই উন্নয়নে রাষ্ট্রের এই পানিশমেন্ট দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি হয়ে পড়েছে। পাহাড়ের মানুষ এখন আর বিতর্কিতদের সহজে মেনে নিতে চান না, যদিও দিনশেষে মেনে নিতেই বাধ্য হন। তাই পানিশমেন্ট বদলির জন্য বিকল্প খুঁজেন। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পানিশমেন্ট জোন হিসাবে আদি সময়ের ভাবনা পাল্টান, দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। সব কিছু আরও সুন্দর হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী