সোহানুর রহমান, লম্বাছড়া থেকে ফিরে
দীঘিনালা: খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার ১ নম্বর মেরুং ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা লম্বাছড়া কাশিঁরাম পাড়া। শহুরে যান্ত্রিকতা আর কোলাহল থেকে অনেকটা দূরের ওই এলাকায় যাওয়ার জন্য নেই তেমন ভালো কোনো সড়ক। দীঘিনালা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে মেরুং বাজার; এরপর টানা দুই ঘন্টা পাহাড়ি পথে হেঁটেই পৌঁছাতে হয় সেখানে। সঙ্গত কারণেই অনেক নাগরিক সুবিধা ছুঁয়ে যায়নি ওই এলাকাকে। ঘটেনি শিক্ষার প্রসারও।
দুর্গম ওই এলাকার আশেপাশে ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও ছিল না কোনো উচ্চ বিদ্যালয়। ফলে প্রাথমিক শেষের পর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে প্রতিদিন দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ছোট মেরুং উচ্চ বিদ্যালয়ে আসতে হত শিক্ষার্থীদের। এমন পরিস্থিতিতে দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আরাফাতুল আলমের নজরে আসে দুর্গম গ্রামটি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামানের সার্বিক প্রচেষ্টায় অবশেষে সেখানে ‘জেলা প্রশাসন স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চলতি বছরেই নির্মাণ কাজ শেষ করে নতুন বছরের শুরুতে ষষ্ঠ-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরুর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
অপরদিকে, এই গ্রামের কৃতী সন্তান জেলা আধুনিক সদর হাসপাতালে অর্থপেডিক বিভাগের পরামর্শক ডা. নয়ন ময় ত্রিপুরা এগিয়ে আসলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়। পৈতৃক সম্পদের ৪০ শতক জমি দান করলেন তিনি। আর স্কুলটির ভবন নির্মাণে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন দিয়েছে ২০ লাখ টাকার অনুদানের ঘোষণা।
সরজমিনে যা দেখা গেল
গত সোমবার (১৯ জুন) সকাল ১১টায় উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সেই এলাকায় রওনা দেন এই প্রতিবেদক।উপজেলার মেরুং পর্যন্ত যাতায়াত ভালো থাকলেও এর পরের অবস্থা ছিল দুর্গমতায়। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় পাহাড়ি রাস্তার রূপ অনেকটা কাঁদায় ছেয়ে গেছে। এসব রাস্তায় পায়ে হেঁটে যেতে হয় স্থানীয়দের। কারণ, সেদিকে যাত্রীবাহী কোনো গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা নেই।
তবে এলাকাটিতে পৌঁছে পাওয়া গেলো উন্নয়নের ছোঁয়া। প্রথমেই চোখে পড়লো প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়া আশ্রয়ন প্রকল্পের ২১টি ঘর। চোখে পড়বে মুজিববর্ষের স্মারক লম্বাছড়া কাঁশিরাম পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক। ঠিক এর পাশেই প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ‘জেলা প্রশাসন স্কুল অ্যান্ড কলেজ’। মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্গম লম্বাছড়া এলাকার ১৩টি গ্রামের শিক্ষার্থীরা সহজেই মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পাবে।
স্থানীয় শিক্ষার্থী রেজিনা ত্রিপুরা ছোট মেরুং উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে হীরা দেবী ত্রিপুরা, কলিতা ত্রিপুরা ও মেকাপ ত্রিপুরা ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। বিদ্যালয় ছুটির পর এক সঙ্গে দলবেঁধে গ্রামে ফিরছে তারা। কথা হয় তাদের সঙ্গে। জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুলের জন্য বেরিয়ে যাই, পাহাড়ি পথ ও ছড়া পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয়।’
স্থানীয় কার্বারি চঞ্চয় বিকাশ চাকমা বলেন, ‘গ্রামগুলো অনেক দূরে দূরে হওয়ায় এ এলাকার শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য দুই ঘন্টা পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। বিদ্যালয় ছুটির পর আবারও পায়ে হেঁটে দলবেঁধে গ্রামে ফিরে আসে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হলে ছাত্র-ছাত্রীদের কষ্ট কমবে।’
কাঁশিরাম পাড়া থেকে আরও দুর্গম গ্রামে (রাইন্ন্যা পাড়া) বসবাস করেন নব বিকাশ ত্রিপুরা (৫৫) ও ধবলা ত্রিপুরা (৪৫)। তাঁদের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করে দূরের ছোট মেরুং উচ্চ বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খবর পেয়ে আনন্দে ছুটে আসে তিনি। কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘ছেলে-মেয়েরা ঘুম থেকে ওঠে পাহাড়ি ছড়া ধরে প্রতিদিন স্কুলে যায়। সকাল ৭টায় স্কুলের জন্য বাড়ি থেকে রওনা দেয়, ফিরে আসে সন্ধ্যা ৭টায়। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হলে ছেলে-মেয়েদের আর দুঃখ থাকবে না।’
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আরাফাতুল আলম বলেন, ‘উপজেলার লম্বাছড়া এলাকা অত্যন্ত দুর্গম। ওই এলাকার আশেপাশে ৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। কাজেই শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন দুই ঘন্টা পায়ে হেঁটে ছোট মেরুং উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসে। এ সমস্যা নিরসনে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মহোদয় দুর্গম এলাকাটিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টির জমি ও নকশা জরিপ সম্পূর্ণ হয়েছে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর আর এ সমস্যা থাকবে না।’
ইউএনও বলেন, ‘এলাকাটি দীর্ঘদিন থেকে নাগরিক সেবা থেকে পিছিয়ে ছিল, এখন সমৃদ্ধির পথে। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আশ্রয়ন প্রকল্পের ২১টি ঘর, ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়ার কাজ চলমান রয়েছে।’