রবিবার, নভেম্বর ১০, ২০২৪

রাঙামাটি জেলা পরিষদ বিশ্রামাগারের ৫ কক্ষ দুই বছর ৩ সদস্যের দখলে !

শিজক রিপোর্ট
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আয়ের অন্যতম উৎস নিজস্ব দুইটি বিশ্রামাগার (রেস্টহাউজ)। সাদা রঙের তিনতলা ভবনে ১৮টি ও আকাশি রঙের চারতলা ভবনে ১২টি কক্ষ মিলিয়ে তিন ক্যাটাগরির মোট ৩০টি কক্ষ রয়েছে দুটিভবনে। তবে আকাশি রঙের ভবনের প্রথম ও চতুর্থ তলার সব’কটি রুম জেলা পরিষদের তিন সদস্যের দখলে। সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যমতে, পরিষদের নতুন পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ২০২১ সাল থেকেই তিনজন সদস্য জেলা শহরে তাদের বসবাসের ‘ঘর নেই’ এই অজুহাতে সাধারণ ও ভিআইপি মানের পাঁচটি কক্ষ দখলে রেখেছেন! এতে করে কক্ষগুলো ভাড়া দিতে না পারায় নিজস্বআয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রাঙামাটির ‘হেভিওয়েট’ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পার্বত্য জেলা পরিষদ।

অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাদা রঙের বিশ্রামাগারের কক্ষ সংখ্যা ১৮টি। তিনতলা বিশিষ্ট ভবনটিতে তিনটি ভিআইপি কক্ষ, চারটি সেমি-ভিআইপি ও এগারোটি সাধারণের মানের বা ননভিআইপি কক্ষ রয়েছে। তন্মধ্যে ভিআইপি কক্ষের দৈনিক ভাড়া ১২০০, সেমি-ভিআইপি ৮০০ ও সাধারণ কক্ষের মধ্যে টুইন বেড (দুই বিছানা) ৫০০ ও সিঙ্গেল বেড (এক বিছানা) ৩০০ টাকা। চারতলা বিশিষ্ট আকাশি রঙের বিশ্রামাগারের কক্ষ সংখ্যা ১২টি। ভিআইপি কক্ষের দৈনিক ভাড়া ১০০০ টাকা এবং সাধারণ কক্ষের ভাড়া ৩০০ টাকা। পুরো ভবনের প্রথম ও চতুর্থতলা মিলে ৫টি কক্ষ জেলা পরিষদের তিন সদস্যের দখলে রয়েছে। তিনটি কক্ষ বেডসিট ও আসবাবপত্রের অভাবে চালু করা যায়নি। এই ভবনের নিচতলায় দুই কক্ষ রয়েছে; পুরো নিচতলা জেলা পরিষদ সদস্য আছমা বেগমের দখলে রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় চারটি ও তৃতীয় তলায় তিনটি কক্ষ রয়েছে। সেখানে তিনটি কক্ষ এখন বালিশ ও বেডসিটের অভাবে অব্যবহৃত আছে বলে জানা গেছে। তবে চতুর্থ তলায় তিনটি ভিআইপি কক্ষ থাকলেও পরিষদের দুই সদস্য নিউচিং মারমা ও দীপ্তিময় তালুকদারের দখলে এই তলাটি। আছমা বেগমের দখলে থাকা সাধারণ কক্ষগুলোর দৈনিক ভাড়া ৩০০ টাকা, নিউচিং মারমা এবং দীপ্তিময় তালুকদারের দখলে থাকা ভিআইপি কক্ষগুলোর দৈনিক ভাড়া ১০০০ টাকা।

২০২০ সালের শেষদিকে পরিষদের নতুন পর্ষদ পুনর্গঠনের পর থেকেই তারা তিনজনে মিলে পাঁচটি কক্ষ দখলে নিয়েছেন। বিগত দুই বছর ধরে তাদের দখলেই রয়েছে। দৈনিক হিসাবে কক্ষভাড়া বাবদ টাকা নিলে জেলা পরিষদ আছমার দখলে থাকা ১০১ এবং ১০২ নম্বর সাধারণ মানের দুইটি কক্ষ থেকে পরিষদের দুই বছরে ৪ লাখ ৩৮ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। অন্যদিকে, নিউচিং মারমার দখলে থাকা চতুর্থ তলার ৪০১ এবং ৪০২ নম্বর ভিআইপি কক্ষ থেকে দুই বছরে ১৪ লাখ ৬০ টাকার আর দীপ্তিময় তালুকদার থেকে ৪০৩ নম্বর রুমবাবদ ৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। তিন সদস্যের দখলে থাকায় পাঁচটি কক্ষ ভাড়া দিতে না পারছেনা বিশ্রামাগার কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগ রয়েছে, জেলা শহরে বসবাসের মতো বাসাবাড়ি নেই- এ অজুহাতে তিনটি ভিআইপি ও দুইটি নন-ভিআইপি রুম দখলে নিলেও জেলা পরিষদ সদস্য আছমা বেগম ছাড়া অপর দুই সদস্য নিউচিং মারমা ও দীপ্তিময় তালুকদারের পরিবারের কেউ রেস্টহাউজে থাকেন না। এই পাঁচটি কক্ষ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পরিষদ সদস্যদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত নেতারা পরিষদের রেস্টহাউজে আশ্রয় নিলেও ভাড়া পরিশোধ করেন না। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিজস্ব আয়ের যেসব খাতসমূহ রয়েছে তারমধ্যে জেলা পরিষদের বিশ্রামাগারটি অন্যতম। নিজস্ব আয়খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৩ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তারমধ্যে শুষ্কফাঁড়ি হতে ১ কোটি ৭০ লাখ, ভূমি হস্তান্তর কর বাবদ ৭০ লাখ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ফি বাবদ ২০ লাখ টাকা এবং বিবিধআয়ের হিসাবে ব্যাংক মুনাফা, বিশ্রামাগার ও বাড়িভাড়া বাবদ ৪০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, পরিষদের নিজস্ব আয়খাতে বিশ্রামাগার হতে বাৎসরিক ৫ লাখ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রতিবছরই ঘাটতি থেকে যায়।

২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নতুন পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। পুরোনো দুই পর্ষদের সদস্য ও জেলার কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুই প্রু চৌধুরী নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরিষদের নতুন পর্ষদে ১৪ সদস্যের মধ্যে প্রথমবারের মতো সদস্য হন কাপ্তাই উপজেলা হতে দীপ্তিময় তালুকদার, রাজস্থলী উপজেলা হতে নিউচিং মারমা, লংগদু উপজেলা হতে বিগত পর্ষদের সদস্য মৃত মো. জানে আলমের স্ত্রী আছমা বেগম। তিন সদস্যের মধ্যে নিউচিং মারমা জেলা আওয়ামী লীগের সদ্যবিগত কমিটির সদস্য ছিলেন। দীপ্তিময় তালুকদার কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও আছমা বেগম লংগদু উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বপালন করছেন।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য দীপ্তিময় তালুকদার বলেন, ‘আমি সদস্য হওয়ার পর মাঝেমধ্যে রাঙামাটি গেলে রেস্টহাউজে (বিশ্রামাগার) থাকি, তবে সব সময় থাকি না।’ ভাড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে কিছু তো দিতে হয়। দায়িত্ব যারা আছে তাদের দিই।’

আরেক সদস্য নিউচিং মারমা চতুর্থ তলার ৪০১ ও ৪০২ নম্বর কক্ষে নিজে থাকেন বলে নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনিও রাঙামাটি শহরে পরিষদের বৈঠক উপলক্ষে আসলেই কেবল থাকেন বলে জানিয়েছেন। তবে আরেকজন সদস্য আছমা বেগমের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তিন সদস্যের দুইটিতলা দখল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা পরিষদের দুইটি বিশ্রামাগারের (রেস্টহাউজ) দায়িত্বে থাকা প্রিয় চাকমা কোনো ধরণের তথ্য জানাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। প্রিয় চাকমা বলেন, ‘সদস্যরা টাকা দেন নাকি দেননা এসব বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহা. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্রামাগার পরিষদের নিজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস হলেও বিভিন্নসময়ে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বেড়াতে আসেন। আর বিগত দুই-তিন বছরে করোনার প্রভাবে আমাদের আয় তেমন একটা হয়নি।’

৩ জন সদস্যের দখলে থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সদস্যদের নিজস্ব কোয়ার্টার না থাকায় কয়েকজন সেখানে থাকেন। সদস্যদের থাকার জন্য চেয়ারম্যান বাংলোর পাশে কোয়ার্টার তৈরি হয়েছে, সেখানে ঝর্ণা খীসাসহ কয়েকজন বোধহয় উঠেছেন। আর যে কয়েকজন পরিষদের বিশ্রামাগারে থাকেন তারা ভাড়া দেন কী-না বিষয়টি আমার নিশ্চিতভাবে জানা নেই।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস দেয়া হলেও তাতেও সাড়া দেননি চেয়ারম্যান।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালে সাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির কারণে দেশের ৬১ জেলা পরিষদের চেয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ভিন্নতা রয়েছে। পাহাড়ের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ‘হেভিওয়েট’ বা ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান বলা হয়ে থাকে পার্বত্য জেলা পরিষদকে। তবে ১৯৮৯ সালে ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ’ নামের প্রথম পরিষদের নির্বাচনের পর টানা তিন দশকেও আর কোনো নির্বাচন হয়নি পার্বত্য জেলা পরিষদে। বিগত পর্ষদগুলোতে যখন যে সরকার ক্ষমতাসীন ছিল; তাদের দলীয় মনোনীতরাই দায়িত্বপালন করেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য হিসেবে। তবে নারীরা সদস্য হিসেবে জেলা পরিষদের দায়িত্বে এলেও বান্দরবান বাদে এখনো নারী চেয়ারম্যান পায়নি খাগড়াছড়ি-রাঙামাটির মানুষ।

সম্পর্কিত খবর

সোশ্যাল মিডিয়া

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর