প্রান্ত রনি, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
রাঙামাটি: জেলা শহরের ২২ শতাংশ বাসা-বাড়িতে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার লার্ভা মিলেছে। গত জুলাই মাসে দুই সপ্তাহব্যাপী জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় এডিসের উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য সার্ভের (জরিপ) কাজ শুরু করে জেলা সিভিল সার্জন (সিএস) কার্যালয়। সার্ভেতে শহরের ২২ শতাংশ বাসা-বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছে।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, জেলা শহরে সবচেয়ে ডেঙ্গুর লার্ভা পাওয়া গেছে কল্যাণপুর এলাকায়। মশক নিধনে দেশব্যাপী কাজ করে থাকে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনসমূহ। তবে খোদ রাঙামাটি পৌরসভা অফিসের সামনেই দুইটি টায়ারেও পাওয়া গিয়েছে এডিসের লার্ভা!
সিএস অফিসের এডিস মশার লার্ভা পরীক্ষার জরিপের তথ্য বলছে, ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার লার্ভাপ্রাপ্ত বিভিন্ন এলাকার মধ্যে রয়েছে শহরের মাস্টার কলোনী, মসজিদ কলোনী, ওয়াপদা কলোনী, পুরাতন বাস স্টেশন, পাথর ঘাটা, মুসলিম পাড়া, চম্পকনগর, রাঙামাটি পৌরসভা অফিস, কল্যানপুর ও রায় বাহাদুর সড়ক। এদিকে, মশার বংশবিস্তার ধ্বংসে পৌরসভার মশক নিধন কার্যক্রমে পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন এলাকায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করছে সিএস অফিস।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘সারাদেশের মতো রাঙামাটি জেলাতেও ডেঙ্গুর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। দেশে জুনের চেয়ে জুলাইয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির কারণে আমরা জুলাইয়ে দুই সপ্তাহব্যাপী জেলা শহরের পাড়া-মহল্লায় একটি সার্ভে শুরু করি। সার্ভে পরিচালনা করে আমরা দেখতে পেলাম শহরের ২২ শতাংশ বাসাবাড়িতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। জেলা শহরের কল্যানপুর, পাথরঘাটা, মসজিদ কলোনী, ওয়াপদা কলোনী, টম্পকনগরসহ বিভিন্ন পাড়াতেই এডিসের লার্ভা পেয়েছি। তবে কল্যানপুরে এসিডের বিস্তার বেশি রয়েছে। রাঙামাটি পৌরসভা অফিসের দুইটি টায়ারেও পাওয়া গেছে এডিসের লার্ভা। আমরা তড়িৎভাবে লার্ভা ধ্বংসের জন্য বলেছি।’
কীটতত্ত্ববিদ বিশ্বজিৎ চৌধুরী আরও জানান, ‘সাধারণত প্লাস্টিক ড্রাম, ফুলের টব, লোহার ড্রাম, রংয়ের কোটা, টায়ার, প্লাস্টিকের বালতিসহ ইত্যাদি ধরণের পাত্রে জমে থাকা পানিতে লার্ভা পাওয়া গেছে। অন্যান্য মশা প্রজননের ক্ষেত্রে পানির প্রয়োজনীয়তা অনেক থাকলেও এডিস মশা এক চামচ পানির মধ্যেও ডিম ফুটাতে বা প্রজনন করতে পারে। এক্ষেত্রে বাসাবাড়িতে যারা বসবাস করছেন তাদেরকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে ঘরে ঘরে গিয়ে লার্ভা ধ্বংস করার সুযোগ নেই। মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।’
উপজেলাসমূহের ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুর মধ্যে বেশিরভাগ রোগী রাঙামাটি শহরের। তবে উপজেলায় রোগী কম। তবে যাতায়াত ব্যবস্থার দুর্গমতার কারণে উপজেলাগুলোতে গিয়ে সার্ভে করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।’
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরে জেলায় মোট ১০৯ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। গতকাল রোববার (১৩ আগস্ট) দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালে মোট ভর্তি ছিলেন ৮ জন। বিকেল পর্যন্ত রাঙামাটি জেলায় রোগীর সংখ্যা দাঁঁড়িয়েছে ১০৯ জনে। এরমধ্যে ৮৬ জনই সদর উপজেলার। বাকী উপজেলাসমূহের মধ্যে বিলাইছড়িতে ৫, নানিয়ারচর ৪, কাউখালীতে ৪, বাঘাইছড়িতে ৩, রাজস্থলীতে ৩, লংগদুতে ৩ ও কাপ্তাই উপজেলায় একজন করে রোগী পাওয়া গেছে। তবে জেলার জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলায় এখনো পর্যন্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি। তবে আশার কথা হলো জেলায় এখনো মৃত্যু নেই।
ডেঙ্গু আক্রান্তের পরিসংখ্যান বলছে, রাঙামাটি জেলার মধ্যে জেলা সদর বা জেলা শহরেই হুহু করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ রোগীই পাওয়া গিয়েছে মূলত জুন-জুলাই- এই দুই মাসে। যেখানে শতাংশ ২২ বাসাবাড়িতেই পাওয়া গেছে এডিসের লার্ভা।
জানতে চাইলে রাঙামাটি জেনালের হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. শওকত আকবর জানান, ‘রোববার দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালে আটজন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। এ পর্যন্ত রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সেবা নিয়েছেন ১০৯ জন। তবে জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু নেই। ৮-১০ জন ক্রিটিক্যাল রোগীকে রেফার করা হয়েছিল।’
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও জেলা সিভিল সার্জন (সিএস) ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী বলেন, ‘রাঙামাটিতে প্রথম দিকে যেসব রোগী পাওয়া গিয়েছিল বেশিরভাগ জেলার বাহিরে থেকে আক্রান্ত হয়ে এসেছিল। স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় আমরা এলাকায় এলাকায় মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতনতার বিকল্প নেই।’
এদিকে, এডিস মশার বিস্তার নিয়ে সার্ভে শেষে পৌর এলাকায় এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ২৪ এপ্রিল রাঙামাটি পৌরসভাকে একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করেছে সিভিল সার্জন (সিএস) কার্যালয়। প্রতিবেদনে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য লার্ভানাশক স্প্রে, ফগিং, পরিত্যক্ত পাত্র অপসারণে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মশক নিধনে কার্যক্রমে রাঙামাটি পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, রাঙামাটি শহরে ডেঙ্গুর অতিরিক্ত প্রকোপ না থাকায় সিভিল সার্জন অফিস যে এলাকায় এডিস লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে; সে খবর আমাদের জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তড়িৎভাবে লার্ভা নিধনে কাজ করছি। সিএস অফিস যেভাবে বলছে, আমরা সেইভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। শহরের মধ্যে কল্যানপুর, রায় বাহাদুর সড়ক ও চম্পকনগর বেশি মশক নিধন কার্যক্রম চালানো হয়েছে।