শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪

লস্ট ইন ট্রানজিট

আনোয়ার হাকিম

আমার জন্ম অটামের কনকনে শীতের রাতে কোন এক কারিগরের হাতে সিজারিয়ানের মাধ্যমে। জন্মের পর কোয়ালিটি কন্ট্রোলের লোকজন এসে আমাকে নাড়াঘাটা করে দেখে যায়। আমি পরিপূর্ণ রূপে ভূমিষ্ঠ হয়েছি দেখে তারা কিউসি পাসড ট্যাগ মেরে চলে যায়। সেই রাতেই আমাকে বস্তাবন্দী করে কোথায় যে নিয়ে যাওয়া হয় বলতে পারি না। যখন আমাকে উন্মুক্ত পরিবেশে আনা হয় তখন দেখি চারিদিক সূর্যালোকিত, বাইরে কোলাহল, দূরে গাড়ীর শব্দ। আমি আমাকে আবিষ্কার করলাম কোন এক শপিং মলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। আমার খুব স্বস্তি বোধ হচ্ছিল। আর যাই হোক এখানে শীতাতপের ঠান্ডা হাওয়া আছে, সুমিষ্ট সুগন্ধ ফ্র্যাগরেন্স আছে। তাকিয়ায় উপবিষ্ট হয়ে আমি নানা রকম, নানা ভাষী লোকের কথাবার্তা, খুনসুটি, আনন্দের ঝিলিক দেখি, কপোত-কপোতীদের আরও কিছু দৃশ্য দেখি, যা আমার প্রাত্যহিক একঘেয়েমিকে দূর করে দেয়। স্টোরের বালিকাদের সরু সরু ঢেড়স আঙ্গুলের স্পর্শ পেয়ে থাকি। মাঝে মধ্যে কাস্টমারদের ছোঁয়া পাই, তাদের মাথায় ক্ষনিকের মুকুট হই। অনেকেই নেড়েচেড়ে দেখে কিন্তু আপনার করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ ট্রলিতে তুলে না।

আমার তাই মাঝেমধ্যে খুব মন খারাপ করে। নিজেকে অভাগা ভাবি। দুঃখ হয় এ জীবনে বোধহয় আর ফ্যামিলি লাইফ উপভোগ করা সম্ভব হবে না। আবার মাঝেমধ্যে এও ভাবি যে, এই বা মন্দ কি? কত লোকের সাথে দেখা হয়, সান্নিধ্য হয়। তাদের কথাবার্তা শুনি, আমার রূপের প্রশংসা শুনি। কেউ কেউ আবার নেড়েচেড়ে মুখ ব্যাঁকা করে চলে যায়। তখন আমার খুব মন খারাপ হয়। তখন মনে হয়, জন্মই আমার আজন্ম পাপ। যারা আমাকে পছন্দ হয় না বলে তাকিয়ায় অবজ্ঞা ভরে রেখে যায় তাদের উপর আমার খুব রাগ হয়। করুণাও হয়। করুণা হয় এই কারণে যে আমারও তো অনেককে পছন্দ হয় না। অথচ কাস্টমাররা তা বুঝে না। শুধু নিজের পছন্দ নিয়েই পড়ে থাকে। থাকুক। আমি এখানেই ভালো আছি।

এভাবেই কাটছিলো আমার আটপৌরে জীবন। আমার বয়স বাড়ছে। কিন্তু এখনো পাত্রস্থ হতে পারছি না ভেবে নিজে থেকে গুটিয়ে থাকি। আর ভাবি এই বুঝি কেউ এলো, আলতো হাতে তুলে নিলো। মাথার তাজ করে ট্রলিতে তুলে নিয়ে গেলো। ভাবতে ভাবতেই অবাক হয়ে দেখলাম এক বয়ষ্ক ভদ্রলোক আমাকে তুলে নিলেন। মাথায় তাজ করে আয়নায় খানিকক্ষণ দেখলেন। সাথে আছেন যিনি, তিনি তাঁর স্ত্রী হবেন বোধহয়। ভারি মিষ্টি। অপত্য স্নেহে তুলে নিলেন ট্রলিতে। আমারও তাদেরকে খুব পছন্দ হলো। আমার জন্ম স্বার্থক ভেবে খুব আনন্দ পেলাম। সেখান থেকেই তাদের ফ্যামিলির সহগামী হয়ে গেলাম। তাদের সাথেই ঘুরতে থাকলাম ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, আলবার্টা, কুইবেক। একান্ত আলাপচারিতায় বুঝতে পারলাম এই দম্পতি ইংরেজিতে কথা বললেও সিংহভাগ সময় কোন ভাষায় যেন কথা বলে। আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। পরে বুঝলাম এরা পরিব্রাজক। ঘুরতে এসেছেন এখানে। চলে যাবেন সহসা। এতে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। সহসাই আমার জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে কিছুটা কাতর হয়ে পড়লাম। আমার বর্তমান মালিকের আচার-আচরণ, সভ্যতা-ভব্যতা জ্ঞান দেখে ভাবলাম আমার জন্মের ঠিকানা শুধু মাত্র মেইড ইন কানাডা। কিন্তু আমার কর্মক্ষেত্র সারা বিশ্ব। আমার আরও ভালো লাগে আমাকে ভদ্রলোকের খুব পছন্দ হয়েছে দেখে। তিনি প্রায় সময় আমাকে মাথার তাজ করে রাখেন। নেড়েচেড়ে দেখেন। সাথে করে নিয়ে যান যেখানে যান। ভদ্রমহিলাও বেশ ভালো। আমাকে দেখতে ‘বেশ’ বলে মন্তব্য করেন। আমার জন্ম স্বার্থক ভেবে আমি যারপরনাই আপ্লুত হয়ে পড়ি।

এভাবে চলছিলো ভালোই। একদিন বুঝতে পারলাম আমি বিদেশ পাড়ি দিচ্ছি তাদের সাথে। প্রথম বিদেশ যাত্রার উত্তাপে আমি যুগপৎ আনন্দিত ও উৎকন্ঠিত। প্রথম উড্ডয়ন সুখ অনুভব করলাম। স্মৃতিতে তা অমলিন হয়ে থাকবে চিরদিন। এরপর যাত্রা বিরতিতে তুরষ্কের ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে থামলাম লম্বা ট্রানজিটের জন্য। শুরু হলো আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার পালা। মনিবের পেরেশানি মাথার উপর থেকে দেখা ছাড়া আমার আর কীইবা করার ছিলো। ইতিউতি যাতায়াতে ত্রস্ত-বিধ্বস্ত আমার মনিব। আমার খুব মায়া হলো। মনিব পত্নীর চেহারায় অজানা আশংকার ছাপ স্পষ্ট। এত কিছুর পরেও আমার খুব ভালো লেগেছে মনিবের ভালোবাসা আর মনিব পত্নীর আমাকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা দেখে।

ট্রানজিটে মনিব ঝিমুচ্ছে, মনিব পত্নীও। আমি সদা জাগ্রত। আহারে মনিব দম্পতি, ভ্রমণে ক্লান্ত, বয়সে ভারাক্রান্ত। জঠর জ্বালায় কাতর। আর কতক্ষণ এই অপেক্ষার পালা জানা নেই। হঠাৎই বোর্ডিং কল। হন্তদন্ত হয়ে তারা হাত লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত। আলুথালু চোখে কাঁধ ব্যাগ আর হাত ব্যাগ নিয়ে তারা উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছে। আমি যে থেকে গেলাম ওয়েটিং বেঞ্চে তা খেয়াল করেননি কেউ। আমি বারবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। জন্ম থেকে আমি বাকশক্তি রহিত, চলৎ শক্তিতে জড়। আমার অন্তরের কোন কাকুতি, মিনতিই তাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়লো না। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে। আচম্বিত মাথায় বিরাট প্রশ্ন উদিত হলো, আমার এখন কী গতি হবে? আমি ক্রমে ক্রমে শংকিত হয়ে পড়ছি। আমি নিশ্চিত আমার মৃত্যুকাল অত্যাসন্ন। এয়ারপোর্টে সব কুলীনদের যাতায়াত। এরা সৌখিন। এরা পরিব্রাজক। এরা খানিকটা উন্নাসিক টাইপের। পয়সা ওয়ালা। অপরের ফেলে যাওয়া জিনিস ছোঁয় না।

বিশেষত করোনা অতিমারিকালে মানুষে মানুষে দূরত্ব বেড়েছে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সবাই সবার জন্য বিপদজনক হয়ে উঠেছে। একজন আরেকজনের পরিত্যক্ত জিনিস ব্যবহার করে না। ‘পরিত্যক্ত’ শব্দটা ধক্ করে খোঁচা মেরে গেলো। আমি পরিত্যক্ত? লাওয়ারিশ? মনিবের জন্য আমার খুব মায়া হলো। আবার গোস্যাও হলো। হয়ত মনের ভুলে আমাকে মাথায় করে নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। এখন হয়ত বোর্ডিং এরিয়াতে বসে আমার জন্য দুঃখ করছে। অথবা বাড়ী ফেরার উত্তাপে আমার বিসর্জন ব্যাথা এতক্ষণে লঘু হয়ে গেছে। এতসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই খেয়াল করলাম কে একজন, ক্লিনার হবে মনে হয়, বিরস বদনে আমাকে গুঁতো মেরে বেলচাতে উঠিয়ে বিরাট ডাস্টবিনে ছুঁড়ে দিচ্ছে। হয়ত খানিক বাদে ভাগাড়ে স্তুপ করে রাখবে। হয়ত রিসাইকেল মেশিনে ফেলে আমার অস্তিত্ব বিলীন করে দেবে। মনিব হয়ত এতক্ষণে বাংলাদেশগামী ফ্লাইটে উর্ধ্বাকাশে। হয়ত এয়ার হোস্টেসের আতিথেয়তায় মুগ্ধ, হয়ত পানাহার শেষে ক্লান্তিতে-শ্রান্তিতে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। আহারে বেচারা, প্রৌঢ়, বিশালদেহী, বিদেশী, ক্ষনিকের অতিথি।

আমি মৃত্যুর উপত্যকতার দিকে চলছি। আমার শেষকৃত্য কিভাবে হবে আমি জানি না। মনিব কী আমাকে অনাগত কালেও স্মৃতিতে ধরে রাখবে? ট্রানজিটে আমার এই পরিণতি হবে আমরা কি কেউ তা ভাবতে পেরেছি? নিশ্চিত অভিমুখী যাত্রীর মত মনিবকে জানাই শেষ মুহুর্তের স্যালুট, আমাকে মাথায় করে দেশ বিদেশ ঘুরার জন্য। আমার শেষ ইচ্ছে হিসেবে তার কাছে শুধু এতটুকুই চাই, স্মৃতিতে রেখো মোরে অনন্তকাল। মনে রেখো কোন এক বিশেষকালে আমি তোমারই ছিলাম মাথার তাজ হয়ে। পৃথিবীর রঙ আকাশ কি মনে রাখে?

গত ২৯ জুলাই ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে সামার হ্যাটসহ নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা

পাদটীকা
আমার সাবেক সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা স্যার বেশ কয়েকদিনের জন্য সস্ত্রীক কানাডা গিয়েছিলেন ছোট ছেলেকে দেখতে। ফেরার পথে ভ্যাংকুভার থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এসে ট্রানজিট নিতে হয়েছে প্রায় ছাব্বিশ ঘন্টার। সেখানে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া তাঁর বিরক্তিকর অবস্থার আদ্যপান্ত ফেবু পোস্টে তিনি অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। সেই সাথে শখ করে কেনা মাথার সামার হ্যাটটি ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে অনবধানতা বশত ফেলে রেখে আসার কথাও বলেছেন। লেখাটি পড়ে তাঁকে “একটি হ্যাটের আত্মকথা” শিরোনামে রসঘন অথচ বিয়োগান্তক রচনা লেখার অনুরোধ করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে তিনি আমাকেই এই দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কল্পনাশ্রিত রচনা লিখতে বললেন। আমি সাহিত্যিক না। তাই কল্পনার ঘোড়া ছুটাতে পারিনা ইচ্ছে মত। তবু উর্ধতনের অনুশাসন ফেলতে পারিনি। পাঠকের কেমন লাগবে জানি না। জানালে খুশি হবো। প্রিয় স্যার, আমার কল্পনা ও ভাষা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ক্ষমা করবেন।

আনোয়ার হাকিম

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সম্পর্কিত খবর

সোশ্যাল মিডিয়া

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর