প্রান্ত রনি, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
রাঙামাটি: তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি- এই দুই জেলা রয়েছে বন বিভাগের রাঙামাটি অঞ্চলের অধীনে। দুইটি জেলায় ছয়টি বিভাগের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে রাঙামাটি বন সংরক্ষকের কার্যালয়। তবে অঞ্চলটির প্রায় ৬০ শতাংশ জনবলই বর্তমানে শূন্য রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলছেন বন কর্মকর্তারা।
৫৬টি রেঞ্জ কার্যালয়ে ৫৯টি ফরেস্ট রেঞ্জার পদ থাকলেও তার ৫৮টি শূন্য। রেঞ্জ কর্মকর্তার বাড়তি দায়িত্ব পালন করছেন ফরেস্টাররা। কর্মক্ষেত্রে বাড়তি চাপ, নিয়োগ-পদোন্নতি জটে বনকর্মীদের মাঝেও রয়েছে অসন্তোষ। নানান সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বনকর্মীদের প্রান্তিক সেবাদান।
বন সংরক্ষক কার্যালয়ের (সিএফ) দেওয়া তথ্যমতে, বন সংরক্ষকের কার্যালয় রাঙামাটি সার্কেলের অধীনে ছয়টি বিভাগ রয়েছে। ছয়টি বিভাগের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের ২৬৯টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ১২৭ জন, শূন্য রয়েছে ১৪২টি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ৩১৪টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ১১০ জন, শূন্য রয়েছে ২০৪টি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের ২২৯টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ৭৯ জন, শূন্য রয়েছে ১৫০টি। অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল বনীকরণ বিভাগের ১৪৪টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ৬৯ জন, শূন্য রয়েছে ৭৫টি।
কাপ্তাই পাল্পউড বাগান বন বিভাগের ১৮৬টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ৫৪ জন, শূন্য রয়েছে ১৩২টি। খাগড়াছড়ি বন বিভাগের ১৩৩টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ৭৪ জন, শূন্য রয়েছে ৫৯টি এবং রাঙামাটি সার্কেল বন সংরক্ষকের কার্যালয়েই ২৬টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ৯ জন, শূন্য রয়েছে ১৭টি। মোট ১ হাজার ৩০১টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে নিয়োজিত রয়েছেন ৫২২ জন, শূন্য রয়েছে ৭৭৯টি। মোট জনবলের হিসাবে বন বিভাগ রাঙামাটি অঞ্চলের প্রায় ৬০ শতাংশ পদই রয়েছে শূন্য।
অফিস সূত্র জানায়, ছয়টি বিভাগের অধীনে ৫৬টি রেঞ্জ কার্যালয়। ৫৬টি রেঞ্জ কার্যালয়ের আওতাধীন ফরেস্ট রেঞ্জার ৫৯টি মঞ্জুরিকৃত পদ থাকলেও ৫৮টি পদই শূন্য। কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে একজন ফরেস্ট রেঞ্জার নিয়োজিত। অন্য রেঞ্জগুলোতে ফরেস্ট রেঞ্জারের দায়িত্ব পালন করছেন ফরেস্টারা। ১৬২টি ফরেস্টার পদের বিপরীতে নিয়োজিত রয়েছেন ৮৫ শূন্য পদ রয়েছে ৭৭টি; ৮৫ জনের মধ্যে ৫৮ জন পালন করছে অতিরিক্ত দায়িত্ব। অন্যদিকে ডেপুটি রেঞ্জারের ৯৫টি পদ থাকলেও এখনো নিয়োজিত নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও উত্তর বন বিভাগে একজন করে উপ-বিভাগীয় বন কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও এই দুইটি পদও শূন্য। ছয়টি বিভাগে ১১টি সহকারী বন সংরক্ষকের পদ থাকলেও নিয়োজিত আছেন ছয়জন। সংরক্ষিত বন সুরক্ষায় দায়িত্বে ৪৫১ জন বনপ্রহরীর বিপরীতে নিয়োজিত রয়েছেন ১৮৮ জন, শূন্য রয়েছে ২৬৩টি পদ। এছাড়া অন্যান্য পদেও বেশির ভাগই জনবল অর্ধেক শূন্য রয়েছে।
মাঠ পর্যায়ের বনকর্মীরা জানায়, জনবল সংকটের প্রভাবে মাঠ পর্যায়ে বন বিভাগের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এক পদের জন্য নিয়োজিত কর্মচারীকেও পালন করতে হচ্ছে বাড়তি দায়িত্ব। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি কার্যক্রম স্থবির থাকায় কাজের বাড়তি চাপ এবং নিয়মানুযায়ী পদোন্নতি না হওয়ায় বন কর্মীদের মাঝেও দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন ফরেস্টার জানায়, তিনি যে বিভাগের অধীনে কাজ করছেন সেই বিভাগে কোনো ফরেস্ট রেঞ্জার নেই। যে কারণে তাকেও বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসাবে। কিন্তু চাকরি জীবনে দীর্ঘ দুই দশক পার হলেও এখনো তাদের অনেকেরই পদোন্নতি হয়নি। নিয়োগ ও পদোন্নতি কার্যক্রম নিয়মমাফিক অনুসরণ করা দরকার বলে জানিয়েছে রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা এই ফরেস্টার।
‘জনবল সংকটের কারণে বন বিভাগের প্রান্তিক সেবাপ্রদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে অবশ্যই আমাদের সেবাদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফরেস্ট রেঞ্জার না থাকায় রেঞ্জ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন ফরেস্টাররা। বনকর্মী সংকটের বনভূমি রক্ষা, অবৈধভাবে জবর দখল ঠেকানো, নিয়মিত নজরদারি-মনিটরিং করা যাচ্ছে না। এছাড়া পর্যাপ্ত জনবল থাকলে দলবল নিয়ে বনের ভেতরে যেতে পারতাম। বন কর্মী সংকটের কারণে অনেক কিছুই করা যাচ্ছে না।’
ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও উপ-বন সংরক্ষক ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, ‘বন বিভাগে অনেক জনবল শূন্য রয়েছে। বর্তমানে ফরেস্ট রেঞ্জার, ফরেস্টার ও বনপ্রহরীসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পিএসসির মাধ্যমে অনেকেই যোগদান করছেন। নিয়োগ ও পদোন্নতি জট খুলে যাচ্ছে। নতুন অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী বিভিন্ন পদ সৃজন হবে ও পদায়ন করা হবে। এতে করে জনবল সংকট অনেকটা কমে আসবে। হুট করে তো নিরসন হবে না, ধীরে ধীরে সংকট কমবে।’
জনবল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেই বন বিভাগ রাঙামাটি অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘গত সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩০ জন বনপ্রহরী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদায়ন হলে তাদের (বনপ্রহরী) অনেকেই রাঙামাটি অঞ্চলে যোগদান করবেন। এছাড়া নতুন করে ফরেস্ট রেঞ্জার, ফরেস্টার নিয়োগ ও পদায়ন করা হচ্ছে; এতে করে জনবল সংকট অনেকটা কমিয়ে আসবে বলে আশা করছি। রেঞ্জ কার্যালয়গুলো ফরেস্ট রেঞ্জারের পদে নিয়োগ না থাকলেও ফরেস্টারগণ ফরেস্ট রেঞ্জারের দায়িত্ব পালন করছেন।’
জনবল সংকটের কারণে সেবাপ্রদান কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে প্ল্যানটেশন (বৃক্ষ সৃজন) কার্যক্রম তেমন নেই। এখানে বন সুরক্ষার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’