প্রান্ত রনি, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
রাঙামাটি: ভৌগোলিকতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরাস্থার দিক থেকে রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলা একটি প্রত্যন্ত উপজেলা। জেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই উপজেলায় যাতায়াতের একমাত্র উপায় নৌ-পথ। সড়কপথে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই। পার্শ্ববর্তী উপজেলা বিলাইছড়ি ও বরকলের সঙ্গে সীমান্ত থাকলেও সড়কপথে যোগাযোগের সড়ক নেই। জুরাছড়ি উপজেলা সদরের এরাইছড়ি মুখ (রাস্তার মাথা) থেকে উপজেলার বনযোগীছড়া ইউনিয়নের হাইল্ল্যারাম পাড়া পর্যন্ত একটি পাকা সেতুর দাবি দীর্ঘদিনের। সেতুটি নির্মিত হলে জুরাছড়ি উপজেলার বাসিন্দাসহ বরকল এবং সদর উপজেলার দুইটি ইউনিয়নের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ২০ হাজার মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
স্থানীয়রা জানায়, সেতু না থাকার ফলে সুবলং খালের নৌ-পথ পার হতে সারাবছরই বয়স্ক মানুষ ও শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়। বর্ষা মৌসুমে সুবলং খালে পানি পরিপূর্ণ থাকা সময়ে রাস্তার মাথা থেকে হাইল্ল্যারাম পাড়া পর্যন্ত নৌকাযোগে যাতায়াতে দুর্ভোগ কিছুটা কম হলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি কমার পর এই নৌ-পথ পার হতে দুর্ভোগ বেড়ে যায়। এসময়ে যে কোনো পণ্য, আসবাবপত্র ও কৃষি পণ্য পারাপারে কষ্ট কয়েকজন বাড়ে। মূলত শুষ্ক কিংবা গ্রীষ্ম মৌসুম পাহাড়ে মৌসুমি বা গ্রীষ্মকালীন ফলের মৌসুম। এই সময়টাতে কমে যায় কাপ্তাই হ্রদের পানিও, হ্রদে পানি কমার ফলে মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণে দুর্ভোগ বাড়ে। বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা কষ্টসাধ্য হওয়ায় অনেকেই মৌসুমি ফল বাজারে আনতে পারেন না। সুবলং খালের ওপর সেতুটি নির্মাণ হলে সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার জট খুলবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) সূত্রে জানা গেছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩’ এর অধীনে জুরাছড়ি সদর ইউনিয়নের এরাইছড়ি মুখ (রাস্তার মাথা) এলাকা থেকে বনযোগীছড়া ইউনিয়নের হাইল্ল্যারাম পাড়া পর্যন্ত সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৭০ মিটার দৈর্ঘ্য পিসি গার্ডার সেতুটি প্রশস্ত ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ২ মিটার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জুরাছড়ি উপজেলা প্রকৌশলী মুহাম্মদ মুতিউর রহমান বলেন, ‘সেতুটি তৈরির জন্য আমরাও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। একনেকে সভায় প্রকল্প অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে।’
সম্প্রতি ওই এলাকায় সরজমিন পরিদর্শনে দেখা গিয়েছে, জেলা সদর থেকে জুরাছড়ি উপজেলায় নৌ-পথে যাতায়াতে দুর্ভোগ বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমের ফলে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমায় জুরাছড়ি সদরে দীর্ঘদিন ধরে নৌ-পথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করলেও বিভিন্ন সময়ে খালেরও মধ্যে নৌকার তলদেশ আটকে যায়। বিভিন্ন সময়ে যাত্রীদেরও নেমে ঠেলতে হয় নৌকা। এখন পানি কমার ফলে রাস্তার মাথা থেকে হাইল্ল্যারাম পাড়া যাতায়াতের খালটি শুকিয়ে আরও সরু হয়ে গেছে। নৌকা দিয়ে খাল পার হয়ে হেঁটে উঠতে হয় দুই পাড়ে। কাপ্তাই হ্রদে পানি না বাড়লে এই দুর্ভোগ দিনেদিনে আরও বাড়বে।
জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সুরেশ কুমার চাকমা বলেন, এই একটি সেতু হলে জুরাছড়ির বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাতায়াতে সুবিধাসহ নানাদিক থেকেই উপকৃত হবেন জুরাছড়ির মানুষ। জুরাছড়ি উপজেলার চারটি ইউনিয়ন, রাঙামাটি সদর উপজেলার বালুখালী এবং বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের মিতিঙ্গাছড়ি এলাকার কিছু অংশের মানুষ এই সড়কপথ দিয়ে সড়কপথে সরাসরি জুরাছড়ি সদরে আসা-যাওয়া করতে পারবেন।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, জুরাছড়ির রাস্তারমাথা এলাকা থেকে হাইল্ল্যারাম পাড়া পর্যন্ত সুবলং খালের ওপর ১৭০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটি নির্মিত হলে ২০ হাজারের অধিক মানুষ উপকারভোগ করবেন। এই সড়ক দিয়ে যখন সরাসরি জুরাছড়ি সদর থেকে সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের বসন্ত পাংখোয়া পাড়া ও বরকলের সুবলং অংশে যাওয়া যাবে। সেতুটির জন্য জুরাছড়িবাসী দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। তবে এখনো আমরা কোনো সফলতার খবর পেলাম না। বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে, সভায়-বৈঠকে আমি নিজেও এই সেতুর দাবি জানিয়েই আসছি।
সুরেশ বলেন, সেতু হলে বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকদের জীবন মানোন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে। এখন অনেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে জুরাছড়ি সদরে কৃষি পণ্য সহজে বাজারজাত করতে পারেন না। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে কৃষকরা তাদের জমিতে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এছাড়া বনযোগীছড়া ইউনিয়নে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শলক কলেজসহ বিদ্যালয়ে আসা আরো সহজ হবে।
জুরাছড়িবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) রাঙামাটি কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আহামদ শফি বলেন, ‘এটি একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সেতু; এই সেতু হলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনমান আরও ত্বরান্বিত হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩ এর অধীনে জেলার বিভিন্ন উপজেলার জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অতিপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ, পুনর্নির্মাণের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করে হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হয়ে গেলে জুরাছড়িবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পূর্ণতা পাবে।’