শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪

বন্যায় পাহাড়ের ৭১ হাজার কৃষকের ৩৮৩ কোটি টাকা ক্ষতি!

প্রান্ত রনি, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
রাঙামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সপ্তাহব্যাপী টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে প্রান্তিক কৃষকরা। কৃষি বিভাগের হিসাবে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন জেলার ৭১ হাজার ২৫০ জন কৃষকের ৩৮৩ কোটি টাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বান্দরবানের কৃষকরা। তিন জেলার মোট ৭১ হাজার ২৫০ জন কৃষকের মধ্যে ৫৬ হাজার ২৫০ জনই বান্দরবানের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি অঞ্চল সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫১ হেক্টর কৃষি জমিতে আউশ ধান, রোপা আমন ধান, গ্রীষ্মকালীন সবজি, আদা, হলুদ, কলা, পেঁপেসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ হয়েছে। এরমধ্যে বন্যায় ও পাহাড়ি ঢলে তিন পার্বত্য জেলার ১৫ হাজার ৮২৭ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। তবে ১২ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবাদ হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ জমির ফসল। আর্থিক হিসাবে তিন জেলার ৭১ হাজার ২৫০ জন কৃষক ৩৮৩ কোটি ৮ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

ডিএই’র দেয়া তথ্যে জেলাভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাঙামাটি জেলায় ৫৯ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমির মধ্যে ৪ হাজার ৬২৮ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। ৩ হাজার ২১৪ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতকরা ক্ষতির হার ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ৬৪১ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৯৮৯ হেক্টর জমির ফসল। জেলার ১২ হাজার ১৬০ জন কৃষক ৬১ কোটি ৩২ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বান্দরবান জেলায় ২০ হাজার ৪২৪ হেক্টর জমির মধ্যে ৯ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। ৮ হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতকরা ক্ষতির হার ৪৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এরমধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৬ হাজার ৩৭৪ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমির ফসল। জেলার ৫৬ হাজার ২৫০ জন ৩১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলায় ৩২ হাজার ৭৯২ হেক্টর জমির মধ্যে ১ হাজার ৩৪৪ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। ৭১০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতকরা ক্ষতির হার ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। এরমধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৭১০ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩৪ হেক্টর জমির ফসল। জেলার ২ হাজার ৮৪০ জন ১১ কোটি ২ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

তবে বান্দরবান ও রাঙামাটির জেলার সব উপজেলা ক্ষতি হলেও খাগড়াছড়ির সদর, দীঘিনালা, মহালছড়ি ও রামগড় উপজেলা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত কয়েক দশকের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিশেষত রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাসা জমির ফসল তলিয়ে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, ঢলের পানি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সময়ে ফসলের ক্ষতি হলেও এবারের মতো ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি পাহাড়ের কৃষি। কৃষকদের এই ভয়াবহ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের প্রণোদনা দরকার।

রাঙামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। এবারের টানা বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সবজি ক্ষেত। সুশান্ত বলেন, এক সপ্তাহের বৃষ্টির কারণে হঠাৎ করেই কাপ্তাই হ্রদের পানি অনেক বেড়েছে। এতে করে কাপ্তাই হ্রদের নিচু এলাকায় আমার যে সবজি বাগান ছিল; সেটি সম্পূর্ণই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কোনো ফসলই রক্ষা করতে পারেনি। হঠাৎ হ্রদের পানি বাড়ায় কেবল আমি নয়; অসংখ্য কৃষক পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

রাঙামাটির দুর্গম একটি ইউনিয়ন হলো বিলাইছড়ি উপজেলার ৩ নম্বর ফারুয়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। এবারের বন্যায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফারুয়ার প্রান্তিক কৃষকরা।

ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মৃনাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘এবারের বন্যায় ফারুয়ার প্রান্তিক মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি সহজে কাটিয়ে ওঠার মতো না। পানিতে মানুষের পুরো বাড়ি-ঘর ডুবে গেছে। আর ইউনিয়নের মূল বাজারে প্রায় অর্ধেক দোকান ভেঙে গেছে। নিচু এলাকায় বিশেষ করে জলে ভাসা জমিতে যে সকল ফসলের আবাদ হয়েছে তার সবই এখন পানিতে তলিয়ে আছে। এছাড়া মানুষের পুকুর ও মাছের ঘের বন্যার পানিতে মিশে মৎস্যখাতেও ক্ষতি হয়েছে। কলা বাগান, পেঁপে বাগানসহ অন্যান্য ফলমূলের বাগানের ক্ষতিও ব্যাপক।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বান্দরবানের উপ-পরিচালক এমএম শাহ্ নেয়াজ বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় বান্দরবানের মোট ৫৬ হাজার ২৫০ জন কৃষকের ৯ হাজার ৮৮৫ হেক্টর কৃষি জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অংকে ৩১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে লামা, সদর উপজেলা, আলীকদম ও রোয়াংছড়িতে। আমরা ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। আশা করছি অতিশীঘ্রই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে বান্দরান পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কিছু আমন বীজ দেয়া হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তপন কুমার পাল বলেন, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে বান্দরবানে। এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা আসলেই কঠিন। আমরা খামারবাড়িতে (কৃষি বিভাগের প্রধান কার্যালয়) উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চলতি আমন মৌসুমে বিভিন্ন ভ্যারাইটির বীজের চাহিদা দিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত জেলার চাহিদা ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরামর্শ নিয়ে চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে।

যদি কৃষকদের মাঝে কিছু আমন বীজ সরবরাহ করা যায় সেক্ষেত্রে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলেন মনে করেন এই কৃষিবিদ।

সম্পর্কিত খবর

সোশ্যাল মিডিয়া

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর