প্রান্ত রনি, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
রাঙামাটি: জেলার একটি জনবসতিপূর্ণ এলাকা কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া। ইউনিয়ন পরিষদের হিসাবে এই ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারের অধিক। ইউনিয়নটির ৯৫ নম্বর (ক) বেতবুনিয়া মৌজা এবং ৯৫ নম্বর কাঁশখালী মৌজার ১০ হাজার ৯২০ একর ভূমির মধ্যে ৬ হাজার ৩২৯ একর ভূমিকে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে।
যদিও ‘রিজার্ভ ফরেস্ট’ ঘোষণার প্রায় দুই যুগ পরে স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, ‘গোপনীয়তা রক্ষা’ করে জনবহুল একটি এলাকাকে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়েছে অযৌক্তিকভাবে। যে কারণে দুইটি মৌজার প্রায় ২০ হাজার মানুষ বর্তমানে উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন। সম্প্রতি দুই মৌজার ৬ হাজার ৩২৯ একর ভূমিকে ‘ডি-রিজার্ভ’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন স্থানীয় হেডম্যানসহ বিশিষ্টজনরা।
প্রধানমন্ত্রী বরাবরে দেয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ রয়েছে- রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের বেতবুনিয়া ও কাঁশখালী মৌজায় ১০ হাজার ৯২০ একর ভূমি রয়েছে। দুইটি মৌজার অধীনে ৫ হাজার পরিবারে ৩২ হাজার মানুষ বসবাস করে আসছে। জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটিতে সজীব ওয়াজেদ জয় উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র, পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টারসহ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৭২ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলে বন বিভাগের আওতায় বনের কোনো অস্তিত্ব নেই।
স্মারকলিপিতে সই করেছেন বেতবুনিয়া মৌজার হেডম্যান ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, কাউখালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শাসশুদ্দোহা চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান অংচাপ্রু মারমা, বেতবুনিয়া মডেল ইউপি চেয়ারম্যান অংক্যজ চৌধুরী, কাঁশখালী মৌজার হেডম্যান তুষার কান্তি দেওয়ানসহ স্থানীয় বিশিষ্টজনরা।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ আমলে বন সংরক্ষণ আইন করা হয়; যা ‘বন আইন-১৯২৭’ নামে পরিচিত। এই আইনের আওতায় ১৯৯৯ সালের ১ মার্চ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে কাউখালী উপজেলার ৯৫ নম্বর (ক) বেতবুনিয়া মৌজা এবং ৯৫ নম্বর কাঁশখালী মৌজার ৬ হাজার ৩২৯ একর ভূমিকে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করা হয়। এরমধ্যে ৯৫ নম্বর (ক) বেতবুনিয়া মৌজার ২ হাজার ৭৬২ এবং ৯৫ নম্বর কাঁশখালী মৌজার ৩ হাজার ৫৬৭ একর ভূমি রয়েছে।
সংরক্ষিত বন ঘোষণার সেই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘১৯৯২ সালের ৪ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উল্লেখিত ভূমিকে সংরক্ষিত বনভূমি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ভূমির অবস্থান ও সীমানা নির্দিষ্ট করে। নির্দিষ্ট ভূমির মধ্যে বা উপরে কোনো ব্যক্তির অনুকূলে কোন স্বত্ত্ব বা অধিকার আছে কীনা বা থাকলে তার প্রভূতি ও বিস্তৃতি নির্ধারণ করার জন্য সেটেলমেন্ট অফিসার নিয়োগ করে। উক্ত বনভূমিতে কারো কোনো স্বত্ত্ব বা অধিকার (দাবি) থাকলে তা করার উত্থাপন করার জন্য সময় নির্ধারণ করে লিখিত বিজ্ঞাপন জারি করা হয়। যেহেতু একই আইনের ধারামতে দাবিসমূহ পেশ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে দাবি পেশ না করার কাণে সকল স্বত্ত্ব/অধিকার বিলোপ ঘটে।’
বেতবুনিয়া মডেল ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়নের বেতবুনিয়া ও কাঁশখালী মৌজার অধীনে ৯টি ওয়ার্ডের ৫০টি পাড়ায় জনসংখ্যা ৩০ হাজারের অধিক। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পরিবার সংখ্যা ৪ হাজার ১০৮টি। বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র ও পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বেতবুনিয়ায় ১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ছোটবড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
যদিও দুইটি মৌজার আওতায় সংরক্ষিত বন এলাকা ঘোষণা করা ৬ হাজার ৩২৯ একর ভূমিতে প্রায় ২০ মানুষ বসবাস করে আসছেন। সংরক্ষিত বন ঘোষিত এলাকায় বসবাসরত মানুষেরা থাকছেন উচ্ছেদ আতঙ্কে। বিভিন্ন সময়ে নিজস্ব বাগানে সৃজিত গাছ কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ কিংবা বিক্রি করতে চাইলেও বন বিভাগের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেতবুনিয়া মডেল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অংক্যজ চৌধুরী জানান, ‘মৌজা থাকার পরেও বন বিভাগ গোপনীয়ভাবে ১০ হাজার ৯২০ একর ভূমির ৬ হাজারের অধিক এলাকাকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে রেখেছে; যা আমরা জেনেছি সাম্প্রতিকসময়ে। কাপ্তাই বাঁধের কারণসহ বেতবুনিয়ার মানুষ নানাভাবে বারবার উচ্ছেদের সম্মুখীন হয়েছেন। এখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণার কারণে ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন। একটি জনবহুল এলাকাকে সংরক্ষিত বন ঘোষণার কোনো যৌক্তিতা নেই এবং বেতবুনিয়ায় বন বিভাগের কোনো বনায়নও নেই। তাই আমরা এই প্রজ্ঞাপন বাতিলের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বেতবুনিয়া মৌজার হেডম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (রাজস্ব) দুই-একদিন বেতবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে গণশুনানির মতো তিনি শুনানি নেন। তখন আমরা তার কাছ দাবি করেছিলাম বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা না করার জন্য। তখনকার দিনে প্রধানমন্ত্রী, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী বরাবর একাধিকবার আমরা স্মারকলিপি দিয়েছি, বেতবুনিয়া ও রাঙামাটিতে মিটিং-মিছিল করেছি। তখন যেসব কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছি তারা আশ্বস্ত করেছেন বাস্তবতার কারণে এখানে রিজার্ভ ফরেস্ট হবে না।’
তিনি বলেন, ‘১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তু অনেক মানুষকে কাঁশখালী ও বেতবুনিয়া মৌজার ভেতরে সেটেল করা হয়। বেতবুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র ও পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠার কারণে সেখান থেকেও উচ্ছেদ হন। বেতবুনিয়া-কাঁশখালী মৌজায় যারা বসবাস করছে তারা বিভিন্নভাবে একাধিকবার উচ্ছেদ হয়েছেন। সর্বোপরি এটি একটি জনঘন এলাকা, এই ধরণের একটি জনবহুল এলাকাকে রিজার্ভ করার কোনো যুক্তিকথা নেই- সেই কারণে ১৯৯২ সালে আমরা এর প্রতিবাদ করেছি।’
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বেতবুনিয়া এলাকায় অনেকাংশে বন্দোবস্তিকৃত ভূমি রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্দোবস্তি বন্ধের কারণের অনেক মানুষ সরকারি খাস জায়গার ওপরও বসবাস করছেন। ওখানে বনায়ন করার কোনো জায়গা নেই, সব জায়গাই মানুষের দখলে। কিন্তু ১৯৯৯ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও আমরা সেটি জেনেছি কিছুদিন আগে। আমরা জানার পর থেকেই এটি বাতিলের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। বন আইন অনুযায়ী সেটেলমেন্ট অফিসার নিয়োগ করে কিছু আনুষ্ঠানিকতা করার কথা থাকলেও সেই সময়ে সেটি করা হয়নি। অনেকটাই গোপনে করা হয়েছে কাগজে-কলমে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, ‘১৯৯৯ সালে সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপন দিয়ে রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার দুইটি মৌজার মোট ৬ হাজার ৩২৯ একর ভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগ সংরক্ষিত বন ভূমির রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। সংরক্ষিত বন ঘোষণার আগে বন আইনে কয়েকধাপে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। এরমধ্যে ৪ ধারায় বিজ্ঞপ্তি জারি, ৬ ধারায় কারো স্বত্ত্ব কিংবা মালিকানা রয়েছে রয়েছে কীনা সেটির জন্য আবেদন গ্রহণ করা হয়। শেষ ধাপে ২০ ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপন দিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে থাকে। ১৯৯৯ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণার পর ২০২৩ সালে এসে স্থানীয়রা এখন আপত্তি জানাচ্ছে, বিষয়টি আমাদের বোধগম্য নই।’
ডিএফও ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে যেখানে মোট ভূমির ৫০ শতাংশের অধিক পর্যন্ত বনভূমি রয়েছে, সেখানে আমাদের রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। জলবায়ু, পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব ও ঝুঁকি মোকাবিলায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা বনায়নের বিকল্প নেই। আমাদের নিয়ন্ত্রণে যে বন ভূমি রয়েছে, সেটি আমরা যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রন করতে চাই দেশ ও জনগণের স্বার্থেই। কাউখালী উপজেলার দুইটি মৌজার পুরো অংশটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল করা হয়নি। কিছু এলাকা সংরক্ষিত বনের মধ্যে পড়েছে। আর সংরক্ষিত বনাঞ্চল যদি অসংরিক্ষত বনাঞ্চল ঘোষণা করতে হয় সেখানে বন বিভাগের পক্ষে কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র সরকার প্রধান চাইলেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারবেন।’
একই কথা বলছেন বন বিভাগ রাঙামাটি অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানও। খোদ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় হেডম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরীর ‘গোপনীয়ভাবে সংরক্ষিত বন ঘোষণার’ অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯২৭ সালের বন আইনের বিধিমালা অনুসরণ করেই সেটেলমেন্ট অফিসার নিয়োগ করেই সংরক্ষিত অধিগ্রহন করা হয়ে থাকে। এই আইনের ৪ ধারায় সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপন, ৬ ধারায় বন-বাসন কর্মকর্তা কর্তৃক উদ্ঘোষণা (সেটেলমেন্ট অফিসার নিয়োগ) ও ২০ ধারায় সংরক্ষিত বন ঘোষণার প্রজ্ঞাপন প্রকাশসহ তিন ধাপে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য স্বত্ত্ব থাকা মানুষ ও বন বিভাগ- এই দুটি পক্ষের বাহিরে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের জেলাপ্রশাসক অথবা অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসককে (রাজস্ব) বন-বাসন কর্মকর্তা নিয়োগ করে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তবুও যদি স্থানীয় জনগণের জন্য রিজার্ভ ফরেস্টকে ডি-রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা প্রয়োজন হয়; সেক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাইলে এই সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।’