স্পেশাল করেসপনডেন্ট
রাঙামাটি: দুর্গম পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্যে রাঙামাটি জেলায় ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করে সরকার। তিন ধাপে জেলার ছয় উপজেলায় ছয়টি আবাসিক ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হলেও চারটি ছাত্রাবাস চালু করা হয়ে ছিল। তবে চলতি বছর থেকে বন্ধ দুইটি ছাত্রাবাসও চালুর উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। তবে আগে থেকে চালু থাকা চারটি ছাত্রাবাসের অবস্থা এখন জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণভাবে সেখানে থাকছেন বিভিন্ন দুর্গম এলাকা থেকে পড়তে আসা প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বলছে, জরাজীর্ণ ছাত্রাবাস মেরামত কিংবা পুনর্নির্মাণের জন্য তড়িত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের জন্য আবাসিক বিদ্যালয় চালু করে সরকার। মূলতঃ যেসব প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই এবং যেসব জুমিয়া পরিবার কোনো স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না; তাদের পরিবারের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় ১৯টি ছাত্রাবাস চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার। তন্মধ্যে তিন ধাপে রাঙামাটি জেলার ছয় উপজেলায় ছয়টি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস (ডিপিইও) সূত্র জানায়, রাঙামাটি ছয়টি ছাত্রাবাস তিন দফায় তৈরি করা হয়েছিলো। প্রথম ধাপে ১৯৮৬ সালে সদর উপজেলায় দক্ষিণ কুতুকছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বিলাইছড়ি উপজেলায় দীঘলছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে ১৯৯৪ সালে বাঘাইছড়ি উপজেলায় পাকুজ্যাছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কাপ্তাই উপজেলায় চোংড়াছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে প্রতিষ্ঠিত চারটি ছাত্রাবাসে ৭৫ জন করে আবাসন সিট রয়েছে। এই চারটি ছাত্রাবাস বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রাথমিকের শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
অন্যদিকে, ২০১১ সালে তৃতীয় ধাপে কাউখালী উপজেলায় চেলাছড়া উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লংগদু উপজেলায় আটারকছড়া উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠার এক যুগ পর চলতি (২০২৩) বছরের জানুয়ারি ছাত্রাবাস দুইটির চালুর উদ্যোগ নেয় সংশ্লিষ্টরা। তবে তৃতীয় ধাপে নির্মিত দুইটি ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থী আবাসন সংখ্যা ৮০ জন। আগের চারটিতে ৭৫ জন হলেও নতুন দুইটিতে ৫টি আবাসন সিট বাড়ানো হয়েছে।
সম্প্রতি রাঙামাটি সদর উপজেলার দক্ষিণ কুতুকছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গিয়েছে, ছাত্রাবাসটিতে শিক্ষার্থীদের থাকার সবগুলো ভবন জরাজীর্ণ হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঝুলে পড়ছে ঘরের সিলিং। দরজা-জানালগুলো পুরোনো হওয়ায় ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। রাতে থাকে মশার উপদ্রব। শিক্ষার্থীদের থাকার ঘরের মেঝেতেও পলেস্তরা ওঠে গেছে। সেমিপাকা ভবনগুলোর বেশকিছু পিলারের মাঝখানে ভেঙে পড়েছে। বলা যায় শিক্ষার্থীদের থাকার মতো ভালো পরিবেশ নেই। এদিকে, অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্নভাবে বসবাসের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর চর্মরোগ দেখা দিয়েছে জানিয়েছে বাচ্চাদের দেখাশোনায় দায়িত্বরতরা।
আবাসিক বিদ্যালয়ের কেয়ারটেকার নন্দিতা চাকমা শিজক ডটকমকে বলেন, ছাত্রাবাসের বাচ্চারা লেখাপড়ার দিক দিয়ে ভালো থাকলেও তাদের থাকার অবস্থা ভালো নয়। অনেকটা পরিত্যক্ত ভবনে তাদের থাকতে হচ্ছে। বৃষ্টির দিনে ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ে। বাচ্চাদের ব্যবহারের জন্য ভালো টয়লেট নেই, খাবার টেবিল নেই, পড়ার টেবিল নেই। এসব নিয়ে আমরা খুব সুবিধায় আছি। এখানে পড়তে আসা বাচ্চারা সবাই দুর্গম এলাকা ও গরিব ঘরের। তাদেরকে যদি আরেকটু ভালোভাবে রাখা যেত; সেক্ষেত্রে একটু ভালো হতো। আমরা তাদের থাকার বিষয়টি নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছি।
আবাসিক বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ডেভিড চাকমা শিজক ডটকমকে বলেন, বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছয়টি ক্লাসে ১৬৮ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। তারমধ্যে আমাদের আবাসিকের (ছাত্রাবাস) ৭৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। মূলতঃ তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আবাসিকে শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়া হয়। আবাসিকের তৃতীয় শ্রেণীর ৩৪, চতুর্থ শ্রেণীর ৩৩ ও পঞ্চম শ্রেণীর ৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। সদর উপজেলায় হলেও আবাসিকে রাঙামাটি সদর, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, কাপ্তাইয়ের শিশুরাও আছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম ও পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর শিশুরাও ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা করছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসটি অনেক পুরোনো ছাত্রাবাস। পাহাড়ে প্রাথমিকে ছাত্রাবাস চালুর উদ্যোগ নেওয়ার পর প্রথম ধাপে দক্ষিণ কুতুকছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসটি ১৯৮৬ সালে স্থাপন করা হয়েছিল। প্রায় চার দশেক আগে স্থাপিত ছাত্রাবাসটি এখন জরাজীর্ণ। কয়েকটি ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সেগুলোতে বাচ্চারা থাকে সেগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। ঝুঁকিপূর্ণ নিয়ে তারা এখানে থাকছে। পড়ার টেবিল, খাবার টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্রের সংকট তো আছেই। ছাত্রাবাসটির প্রতি সুদৃষ্টি প্রয়োজন। দূর-দুরান্ত থেকে এখানে শিশুরা পড়তে এসেছে। তাদের জন্য একটি পাঠ্যযোগ্য পরিবেশের প্রয়োজন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) মো. সাজ্জাদ হোসেন শিজক ডটকমকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকা ও পিছিয়ে জনগোষ্ঠীর শিশুদের পাঠদানের জন্য সরকার রাঙামাটি জেলায় ছয়টি আবাসিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে সদর, বিলাইছড়ি, বাঘাইছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলার চারটি আবাসিক বিদ্যালয় চালু থাকলেও সেগুলোর সব’কটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এগুলো শীঘ্রই সংস্কার কিংবা নতুন অবকাঠামো নির্মাণ প্রয়োজন। আমি উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দিয়েছি উপজেলা শিক্ষা কমিটির মাধ্যমে ও এলজিইডির সহযোগিতায় সম্ভাব্য প্রাক্কলন প্রস্তুত করে আমাদের কাছে দেওয়ার জন্য। আমরা সেটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে পাঠাব।’
তিনি আরও বলেন, কাউখালী ও লংগদু উপজেলায় আরো দুইটি আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস থাকলেও সেটি এতদিন বন্ধ ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই ছাত্রাবাস দুটিও চালু করা হয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তিসহ ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের খাই-খরচের (খাবার) জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করে থাকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এলজিইডি রাঙামাটি সদর উপজেলা প্রকৌশলী প্রনব রায় চৌধুরী শিজক ডটকমকে বলেন, ‘সদর উপজেলার দক্ষিণ কুতুকছড়ি উপজাতীয় আবাসিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ছাত্রাবাসের বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত আছি। তবে ডিপিইও অফিসের আবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নির্দেশনা পেলে আমরা এ ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু করতে পারব। অন্যথায় আমাদের এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই।’
এলজিইডি রাঙামাটি কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আহামদ শফি বলেন, ‘২০১১ সালে এলজিইডি কাউখালী ও লংগদুতে দুইটি ছাত্রাবাস তৈরি করেছিল। পরে সেগুলো রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে অর্থ বরাদ্দ পেলে অন্য ছাত্রাবাসের জরাজীর্ণ ভবন সংস্কার কিংবা নতুন ভবন নির্মাণের প্রয়োজন হলে আমরা সেটি করে দেব।’