লোকাল করেসপনডেন্ট
দীঘিনালা: পার্বত্য চট্টগ্রামে নেই বড় কোনো শিল্প কারাখানা। পাহাড়ের মানুষের প্রধান জীবিকাই মূলত কৃষি। পাহাড়ি নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি কৃষি কাজ করেন। পাহাড়িদের বেশি ভাগই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। অবসরে কেউ কেউ কোমর তাঁতে বুনেন কাপড়। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সাপ্তাহিকহাটে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই। তবে পাহাড়ের এই শিল্পকে নিয়ে সরকারের বিশেষ নজর না থাকায় অবহেলায় এই শিল্প। গৃহ পর্যায়ের বাহিরে গড়ে উঠেনি বড় ধরণের কারখানা।
জানা গেছে, কাঠ ও বাঁশের কাঠি দিয়ে বিশেষ কায়দায় কোমরের সঙ্গে বেঁধে তাঁতে কাপড় বুনে বলে এটিকে বলা হয় ‘কোমর তাঁত’। খাগড়াছড়ির সদর ও পর্যটন এলাকায় স্বল্প পরিসরে কয়েকটি দোকানে পাহাড়ি নারীদের কোমর তাঁতে বুনা শাল, থামি, পিনন, রিনাই (ত্রিপুরা নারীদের পরিধেয় বিশেষ বস্ত্র), ওড়না, রুমাল, গামছা, চাদর, মাফলার ও জামা কাপড় বিক্রি হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও এসব সরবরাহ করা হয় ব্যক্তি উদ্যোগে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার স্থানীয় ত্রিপুরা ও চাকমা জনগোষ্ঠীর নারীরা কোমর তাঁতে কাপড় বুনায় অত্যন্ত পারদর্শী। তাঁরা বাজার থেকে উল এবং পাহাড়ি তুলা থেকে সুতা সংগ্রহ করে ঘরে বসেই কোমর তাঁতে কাপড় বুনে থাকেন। গ্রামের পাহাড়ি নারীদের বেশিরভাগই নিজেদের পোশাক কোমর তাঁতে তৈরি করেই পরিধান করে থাকেন। কয়েকজন জানিয়েছেন, গৃহস্থালি ও পাহাড়ে জুমচাষ করেও তাঁরা ঘরে কোমর তাঁতে কাপড় বুনেন। কোমর তাঁতে পোশাক তৈরি করে প্রতি মাসে একজন নারী ৯-১০ হাজার টাকা পর্যন্তও আয় করতে পারেন।
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নারীরা জানান, একটা সময় পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত তুলা থেকে চরকার মাধ্যমে সুতা তৈরি করে তা দিয়ে পিনন ও থামির কাজ করা হত। তবে বর্তমানে পাহাড়ি তুলার উৎপাদন কমে গেছে। তাই নারীরা বাজার থেকে সুতা ও উল কিনে কাপড় বুনছেন।
সরেজমিন দীঘিনালার মেরুং ইউপির হিতেন্দ্র লাল হেডম্যান পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কোমর তাঁতে পলেন্দ্রি ত্রিপুরা (৪৫) নামের এক নারী ঐতিহ্যবাহী পোশাক রিনাই বুনছেন। পলেন্দ্রি জানান, ‘মায়ের কাছ থেকে কাজ শিখে ৩০ বছর এ কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন। ঐতিহ্যগতভাবে নিজেরাই এসব পোশাক তৈরি করেন। পাশাপাশি গ্রামের নারীরা বললে অর্থের বিনিময়ে তৈরি করে দেন। প্রতিটি রিনাই সুতার গুণগত দিকবিবেচনায় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে বিক্রি হয়ে থাকে। একটি রিনাইয়ের কাজ শেষ হতে প্রায় ১৫- ২০ দিন সময় লাগে।’
দীঘিনালার কামুক্যাছড়ার কোমর তাঁত শিল্পী বাসন্তী ত্রিপুরা বলেন, ‘কোমর তাঁতে বা উঠান তাঁতে যে পণ্যগুলো তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করার কোনো সুযোগ নেই। সরকারিভাবে যদি উদ্যোগ নিয়ে বিপণনের ব্যবস্থা করা না হয়; তবে এ তাঁত উঠনেই থেকে যাবে। সময়ের পরিক্রমায় ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত হারিয়ে যাবে।’
দশকের পর দশক ধরে পাহাড়ি নারীরা এ পেশায় জড়িত রয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি সংসারের ব্যয়ভার ও ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ তাঁত থেকেই আসে বলে জানান তারা। স্থানীয়দের পাশাপাশি পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে কোমর তাঁতে তৈরিকৃত পণ্য বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় দিন দিন এর চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু সরকারি সহায়তা মিলছে না বলে অভিযোগ তাদের।
দীঘিনালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা সুস্মিতা খীসা বলেন, ‘পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারীরা কোমর তাঁতে কাপড় বুনেন। কোমর তাঁত নিয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। জেলায় একটি বিপণনকেন্দ্র ছাড়া কোমর তাঁতের কোনো প্রকার সরকারি প্রকল্প এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) খাগড়াছড়ির সেলাই প্রশিক্ষক ও দীঘিনালা উপজেলা কুটির শিল্পকেন্দ্র প্রধান বসিরুন বেগম বলেন, ‘কোমর তাঁত পাহাড়িদের প্রাচীন পেশা। দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে তাঁত উদ্যোক্তারা চাইলে বিসিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। জেলায় একটি বিপণনকেন্দ্রও রয়েছে। তবে উঠান তাঁত নিয়ে সরকারি কোনো প্রকার ঋণ বা অর্থ বরাদ্দ চালু নেই।’
দীঘিনালা উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান সীমা দেওয়ান বলেন, ‘সাপ্তাহিক হাট ও গ্রামের নারীদের কাছে কোমর তাঁতে তৈরি করা পোশাক বিক্রি করে থাকেন নারীরা। তবে কোমর তাঁতের জন্য স্থানীয়ভাবে কোনো বিপণনকেন্দ্র নেই। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে উপজেলা পর্যায়ে বিপণনকেন্দ্র তৈরি করা গেলে পাহাড়ের নারীরা খুব সহজেই স্বাবলম্বী হবে।’