প্রান্ত রনি, শিজক রিপোর্ট
রাঙামাটি: জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বীর বাহাদুর উশৈসিং কখনো হারেননি। ১৯৯১ সাল টানা ছয়বার আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে ৩০০ নম্বর বান্দরবান সংসদীয় আসনে নির্বাচন করেছেন। জিতেছেন ছয়বারই, শেষ বারে জিতে হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। এর আগের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে হয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী। এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ টানা সাতবারই পেয়েছেন দলের মনোনয়ন।
জয়-পরাজয়ের লড়াইয়ে ‘শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী’ না থাকায় ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন প্রতি বারই। এবারও ভোটের মাঠে বীর বাহাদুরের সঙ্গে ‘শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী’ কেউ নেই বলছেন নির্বাচনি আসনের ভোটাররা। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার চেয়ে বান্দরবানে আঞ্চলিক দলেরও ভোটের মাঠে প্রভাব অনেকটা কম। যে কারণে এবারের নির্বাচনে যদি বিজয়ী হন তবে টানা ৭ বারের মতো বিজয়ী হবেন বান্দরবানের এই নৌকার মাঝি।
বান্দরবান জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এক নামে ‘দাদা’ হিসেবে পরিচিত বীর বাহাদুর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ব্যবসা (রাবার)। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পেশার পরিবর্তন করেননি তিনি। তবে দ্বাদশে এসে ব্যবসায়ের ধরন পাল্টেছেন তিনি; রাবার ব্যবসা ছেড়ে হয়েছেন যৌথ হোটেল ব্যবসায়ী। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃষিখাতে প্রার্থীর নিজস্ব আয় হিসেবে দেখানো হলেও এবার কৃষিতে তার নিজস্ব কোনো আয় নেই।
আরও পড়ুন: দীপংকরের সোনার ভরি ১০, স্ত্রী’র ১২ হাজার টাকা !
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাবার ব্যবসা থেকে তিনি বাৎসরিক আয় দেখিয়েছেন ৪৫ লাখ টাকা। আর অন্য কোনো উৎস থেকে বাৎসরিক আয় ছিল না তার। একাদশের নির্বাচনে কৃষিখাতে ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট এবং দোকান বা অন্যান্য খাতে ভাড়া বাবদ উল্লেখ করেছেন ৭ লাখ ২৫ হাজার ৬২৫ টাকা। ব্যবসা খাতে ৯৫ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৭ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত খাতে ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৭৩৫ টাকা এবং চাকুরি খাতে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ টাকা। এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃষি খাতে তার কোনো আয় নেই। তবে বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট এবং দোকান বা অন্যান্য খাতে ভাড়া বাবদ ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৩১২ টাকা, ব্যবসা খাতে ২ কোটি ৮২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩১ টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত খাতে ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৬৬ টাকা। তবে এবার চাকুরি খাতে বাৎসরিক আয় না দেখালেও সংসদ সদস্য সম্মানি ভাতা দেখালেন ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
বিগত তিন জাতীয় নির্বাচনে হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বীর বাহাদুরের বাৎসরিক নিজস্ব আয় ছিল কেবল ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাৎসরিক নিজস্ব আয় ছিল ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার ৬৮৭ টাকা। ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার বাৎসরিক নিজস্ব আয় দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৪০৯ টাকা। এবারের নির্বাচনে তিনি কেবল হোটেল ব্যবসাতেই বাৎসরিক আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ৮২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩১ টাকা। ১০ বছরের মাথায় বীর বাহারের নিজস্ব আয় বেড়েছে ৭ গুণেরও বেশি!
শিক্ষাগত যোগ্যতা এমএ পাস সম্পন্ন বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। দিনে দিনে ফুলে-ফেঁপে উঠছে তার সম্পদের পরিমাণ। এবারের হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের নগদ টাকা ২ লাখ ৬১ হাজার ৩০৮ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত ৬ কোটি ১ লাখ ২০ হাজার ৬৩৯ টাকা, স্থায়ী আমানতে ১০ লাখ টাকা, মটরগাড়িখাতে ৩ কোটি ৮ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৪ টাকা। স্বর্ণালংকার বাবদ ৫ লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী খাতে ৪ লাখ টাকা এবং আসবাবপত্রে ৩ লাখ টাকা এবং হোটেল ব্যবসা খাতে ৭৫ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে, তার স্ত্রীর রয়েছে নগদ টাকা ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ৬৪১ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত ২ কোটি ৫১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৮৭ টাকা, স্থায়ী আমানতে ২০ লাখ টাকা, মটরগাড়িখাতে ৮৪ লাখ ৫ হাজার টাকা। স্বর্ণালংকার বাবদ ৪ লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী খাতে ৩ লাখ টাকা, আসবাবপত্রে ২ লাখ টাকা, হোটেল ব্যবসা খাতে ৪৩ লাখ টাকা এবং ঠিকাদার ব্যবসায় ২০ লাখ টাকা। বর্তমানে বীর বাহাদুরের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১০ কোটি ৯ লাখ ২২ হাজার ৭২১ টাকা। তার স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮ হাজার ২২৮ টাকা।
আরও পড়ুন: ঊষাতনের আয় কমেছে, প্রতিশ্রুতি গণমুখী উন্নয়নের
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বীর বাহাদুরের নিজের নামে অস্থাবর সম্পদ ছিল নগদ টাকা ৮ লাখ ৭৩ হাজার ২৫ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত ৪ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ১৯১ টাকা, মটরগাড়িখাতে ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৯ টাকা। বিয়েতে প্রাপ্ত ৫০ ভরি স্বর্ণের দাম ৫ লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী খাতে ৪ লাখ টাকা এবং আসবাবপত্রে ৩ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, তার স্ত্রীর রয়েছে নগদ টাকা ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ৮৬১ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত ২ কোটি ৯৬ লাখ ২৪ হাজার ২২ টাকা, মটরগাড়িখাতে ৪৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বিয়েতে প্রাপ্ত ৪০ ভরি স্বর্ণের দাম ৪ লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী খাতে ৩ লাখ টাকা এবং আসবাবপত্রে ২ লাখ টাকা। ৫ বছর আগে বীর বাহাদুরের অস্থাবর সম্পদ ছিল ৬ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ৮৫ টাকা এবং তার স্ত্রীর ছিল ৩ কোটি ৭১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৩ টাকার।
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বীর বাহাদুরের নিজের নামে অস্থাবর সম্পদ ছিল নগদ টাকা ১২ লাখ ৬৩ হাজার ৯১২ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত ১ কোটি ৩৭ লাখ ৩৪ হাজার ৮৯৮ টাকা, মটরগাড়িখাতে ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯০ টাকা। বিয়েতে প্রাপ্ত ৫০ ভরি স্বর্ণের দাম ৫ লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী খাতে ৪ লাখ টাকা এবং আসবাবপত্রে ৩ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, তার স্ত্রীর রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত ১ কোটি ৮৯ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা, মটরগাড়িখাতে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। বিয়েতে প্রাপ্ত ৪০ ভরি স্বর্ণের দাম ৪ লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী খাতে ৩ লাখ টাকা এবং আসবাবপত্রে ২ লাখ টাকা। ১০ বছর আগে বীর বাহাদুরের অস্থাবর সম্পদ ছিল ২ কোটি ২১ লাখ ৪৭ হাজার ২০০ টাকা এবং তার স্ত্রীর ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। ২০১৩ সালে দাখিল করা হলফনামা ও ২০২৩ সালের হলফনামায় যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা গেছে দশ বছরের মাথায় বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ এবং তার স্ত্রীর বেড়েছে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি।
স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে দ্বাদশের হলফনামায় বীর বাহাদুরের নিজের নামে ১০ একর রাবার বাগানের মূল্য দেখানো হয়েছে কেবল ৫ লাখ টাকা আর তার স্ত্রীর নামে স্ত্রীর নামে দুইটি অ্যাপার্টমেন্ট বাবদ ১ কোটি ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৯৬১ টাকা এবং ৫০ একর রাবার বাগান লীজ বাবদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের একাদশের হলফনামায় বীর বাহাদুরের নিজের নামে কৃষি জমি, অকৃষি জমি এবং আবাসিক বা বাণিজ্যিক জায়গা বাবদ ৫ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ৪০০ টাকা। স্ত্রীর নামে ১০০ একর কৃষি জমি (২৫ একর লীজ ও ৫০ একর দান) বাবদ ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা, একটি ফ্ল্যাট বাবদ ৪৬ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ এবং ২৫ একর রাবার বাগান (লীজ) বাবদ ৭৫ হাজার টাকা।
২০১৩ সালের হলফনামায় বীর বাহাদুরের নিজের নামে কৃষি জমি, অকৃষি জমি এবং আবাসিক বা বাণিজ্যিক জায়গা বাবদ ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। তবে একটি বাড়ি উল্লেখ করা হলেও সেটির মূল্য দেখানো হয়নি। অন্যদিকে, স্ত্রীর নামে কেবল ২৫ একর কৃষি জমি বাবদ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা দেখানো হয়েছে। বিগত তিনটি হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একাদশে বীর বাহাদুর ও তার স্ত্রীর স্থাবর সম্পদ বেড়েছে। তবে দ্বাদশে এসে তারা স্থাবর সম্পদ কমিয়ে ফেলেছেন।
তবে দায়-দেনার হিসাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে আছেন পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার কোনো দায়-দেনা না থাকলেও একাদশে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে লি. এর ১ কোটি ৮২ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৮ টাকা ঋণগ্রস্ত ছিলেন। দ্বাদশে এসে ব্যাংক, ব্যক্তি ঋণ (সুদ বিহীন) এবং ফ্ল্যাট ভাড়ার জামানত বাবদ ফেরত বাবদ (অগ্রিম আয়) ১ কোটি ৩৫ লাখ ২৭ হাজার ৯৭০ টাকা ঋণগ্রস্ত আছেন। হলফনামা অনুসারে এক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণও কমেছে তার।
এদিকে, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট করে কোনো নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দেননি বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। দ্বাদশের হলফনামায় পার্বত্য মন্ত্রী নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি নেই। নির্বাচিত হলে জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাব।’ আর অর্জনসমূহে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুতায়ন, পর্যটনশিল্প, আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রতিটি সেক্টরে উন্নতি হয়েছে।’