শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪

‘সব রকমের উপাদান থাকলেও রাঙামাটির পর্যটন বিকশিত হয়নি’

আজ ২৭ সেপ্টেম্বর; বিশ্ব পর্যটন দিবস। সারা বিশ্বের মতো এবারও বাংলাদেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে- ‘পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ (Tourism and Green Investments)’। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিনটি পাহাড়ি জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিগত কয়েকদশকে দেশের পর্যটনখাত যেভাবে এগিয়েছে; তার কতটুকু প্রভাব পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে? পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্প নিয়ে ভাবনা, প্রত্যাশা, করণীয় ও উপেক্ষার বিষয় নিয়ে শিজক ডটকম-র সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছেন রাঙামাটির প্রথম ইকো-রিসোর্ট রাইন্যা টুগুন ইকো রিসোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক। পাশাপাশি তিনি দায়িত্বপালন করছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ত্রিমাত্রিক এর প্রধান নির্বাহী হিসেবেও। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রান্ত রনি

শিজক: ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে পর্যটন শিল্প কতটুকু এগোনোর কথা এবং তার কতটুকু এগিয়েছে বলে মনে করেন?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি একটি অনন্য ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম এ চুক্তি সম্পাদনের আগেরকার অবস্থার সঙ্গে চুক্তি পরবর্তী অবস্থার একটি ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তন আসে। কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত থাকলেও চুক্তি পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে দেশে এবং দেশের বাইরের মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। চুক্তি পরবর্তীতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে অধিকতর মনোযোগী হয়। বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চোখে পড়ার মতো সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। ফলে স্থানীয়দের যোগাযোগ ও উৎপাদিত পণ্য আনা-নেওয়ায় যেমন সুবিধে তৈরি হয়েছে তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অপার সৌন্দর্য দেখতে আসা ভ্রমণ পিপাসুদেরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিগম্যতা বেড়ে যাবার অপরিসীম সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এ চুক্তি পার্ত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এখানকা জন-বৈচিত্র্য, ভাষা, সংস্কৃতি,কৃষ্টি, ঐতিহ্য, জীবনাচার ইত্যাদিকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করায় পর্যটকদের কাছে আরও বেশি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। একজন পর্যটক কেবলমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যই দেখতে আসে না, মানুষও দেখতে আসে- বৈচিত্র্যময় জীবনধারা, সংস্কৃতির আস্বাদ নিতে আসে। রোমাঞ্চকর অনুভূতি ও ভিন্নতর স্বাদও নিতে আসে। তার ওপরে পাহাড় ও হ্রদের অপূর্ব ও অনন্য সাধারণ মিতালীতে গড়ে ওঠা রাঙামাটি ইতোমধ্যে সৌন্দর্যের রাণী পরিচিতি পেয়েছে ও প্রকাশিতও হয়েছে। ভূমিরূপ, পাহাড়, পর্বত, ঝর্ণা, নদী, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ, জীব-বৈচিত্র্য সব মিলিয়ে পুরো রাঙামাটির প্রতিটি এলাকাকে প্রকৃতি তার আপন মহীমায় সাজিয়েছে। এক কথায় পর্যটককে আকর্ষণ করার জন্য সব রকমের উপাদান রাঙামাটির রয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেভাবে রাঙামাটির পর্যটন বিকশিত হয়নি। শহর এলাকাসমূহ প্রথাগত পর্যটনের জন্য সীমাবদ্ধ থাকলেও রাঙামাটির অসীম সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত হচ্ছে ইকো পর্যটন, কমিউনিটি পর্যটন, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন, জৈব কৃষি পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন প্রভৃতি। এ সকল খাতগুলো শ্রম-নিবিড় ও অন্যান্য অনেক খাতসংশ্লিষ্ট বলে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অবকাশ ছিল। যে প্রকারে ও আকারে পর্যটনখাতকে গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল ঠিক সেভাবে আমরা এ খাতকে আমরা প্রায়োগিক গুরুত্ব দিতে পারিনি।

শিজক: পর্যটন শিল্প যথাযথভাবে এগিয়ে না যাওযার প্রতিবন্ধকতা কী মনে করেন।

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: পর্যটনশিল্প যতটা না একক খাত তার চাইতে অনেক বেশি সমন্বিত উদ্যোগ। এ খাতের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যমত এবং অনুমোদন যেমন দরকার তেমনি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, উদ্যোক্তা ও আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় অপরিহার্য। স্বল্পমেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর ও ফলপ্রসূ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সেভাবে বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। একাজগুলো আমরা যথাযথভাবে করতে পারিনি। প্রথাগত পর্যটনের বাইরে রাঙামাটির সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত হলো কমিউনিটি পর্যটন, ইকো পর্যটন, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন, জৈব কৃষি পর্যটন ও সাংস্কৃতিক পর্যটন। এসব খাতগুলোয় উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা নেই বললেই চলে। রাঙামাটির পর্যটন শিল্প উন্নয়নে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে আধুনিক, উদার, পরিবেশ ও প্রতিবেশ-বান্ধব, স্থানীয় ও কমিউনিটি সংযুক্ত পর্যটন বিকাশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ খুবই সীমিত।

সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈশ্বিক সংকট ও মহামারির প্রভাব সবার আগে পর্যটন শিল্পের ওপর পড়ে এবং সবার শেষে এসে স্বাভাবিক হয়। তাই অতিসংবেদনশীল এসব খাতে ইতিমধ্যে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের গৃহীত উদ্যোগকে প্রণোদনা দেয়া এবং সহায়ক অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি। আগেই বলেছি, পর্যটন খাত অতিসংবেদনশীল খাত। একজন পর্যটক সবার আগে নিজের নিরাপত্তা ও স্বস্তি নিশ্চিত না হলে সে এলাকায় বেড়াতে যাবে না। কিন্তু রাঙামাটি সম্পর্কে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতিবাচক প্রচারণা আছে। ছোট-খাটো ও বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নেতিবাচক প্রচারণায় ‘চেইন রি-অ্যাকশন’ হিসেবে এ খাতে বড় প্রভাব ফেলে। উদ্যোক্তা ও যুবদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং এবং পর্যটন খাতে কমিউনিটির সংযুক্তির মাধ্যমে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি বলে আশানুরূপ ‘কমিউনিটি আস্থা অর্জণ ও অংশগ্রহণ’ হয়নি।

কমিউনিটি পর্যটন, ইকো পর্যটন, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের বিকাশ ঘটানোর জন্য ‘access to finance’ এর বিষয়টি কার্যকরীভবে বিবেচনায় আনা হয়নি। নূন্যতম একটি ঘূর্ণায়মান তহবিল (revolving fund) পর্যন্ত গঠন করা হয়ে উঠেনি। পর্যটন ও পর্যটন খাতের সাথে জড়িত সকল অংশীজনকে সমন্বিতভাবে পর্যটন খাতের উন্নয়নে সমবেত করা, কার্যকরী করা ও ফলপ্রসূ করার জন্য দৃশ্যমান ও নিয়মিত কোন ‘বডি’ নেই।

শিজক: পর্যটন শিল্প যতটুকু এগিয়েছে তার কৃতিত্ব কার? সরকারের নাকি ব্যক্তি উদ্যোগ?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: নির্জলা সত্য হলো রাঙামাটিতে পর্যটন শিল্পের বিকাশ এখনও ভঙ্গুর। তবে আশার কথা যে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে এখন প্রায় সবমহল থেকেই এর স্বীকৃতি মিলছে। সরকারতো ব্যাবসা করে না। সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন, নীতি সহায়তা, তহবিল গঠন ইত্যাদি নানাভাবে শিল্প উদ্যোগকে প্রণোদিত ও প্রভাবিত করে। তাই এ শিল্প যতটুকু এগিয়েছে তার কিছু কৃতিত্ব সরকারের তো আছেই। তবে আর সব সেক্টরের মতো শিল্প হিসেবে মূল উদ্যোগ উদ্যোক্তাকেই নিতে হয়। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। তবে অন্য সেক্টরের তুলনায় পর্যটন সেক্টর অতিঝুঁকিপূর্ণ ও অতিসংবেদনশীল বলে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ঝুঁকিও বেশি। সমস্যা ও ঝুঁকির বিষয় বিবেচনায় এ শিল্প বিকাশে উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অসাধারণ।

শিজক: এই সেক্টরের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে করণীয় কী?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী স্থানীয় পর্যটন বিষয়ে মূল ভূমিকাপালনকারী প্রতিষ্ঠান হলো রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। তাই জেলা পরিষদকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেসরকারি বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রভৃতি এবং জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশসহ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে রাঙামাটিতে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন ও অন্যান্য সুবিধাদি গড়ে তোলা এবং তা রক্ষা করার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজ, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব), মহিলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজ, পর্যটন উদ্যোক্তা সংগঠনের সমন্বয়ে সাধারণ পর্যটন, কমিউনিটি পর্যটন, ইকো পর্যটন, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন, জৈব কৃষি পর্যটন ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের উদ্যোক্তা ও নতুন উদ্যোগ চিহ্নিত করা, ক্লাস্টার চিহ্নিত করা, ব্যবসায়িক প্রোফাইল প্রস্তুত করা, উদ্যোক্তা ও সেবা প্রদানকারীদের ডাটাবেজ তৈরি করা।

সহজ গমনাগমনের জন্য এবং উদ্যোক্তাসহায়ক বাস্তব অবকাঠামো যেমন, বিদ্যুৎ, সড়কপথ ও নৌপথ তৈরিতে রাঙামাটির বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে সম্পৃক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠি হিসেবে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, চেম্বার, নাসিব এবং উদ্যোক্তা সংগঠন নিয়ে শক্তিশালী কমিটি গঠন করা; পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; বিদেশী পর্যটকদের রাঙামাটিতে সহজ গমনাগমনের জন্য ভিসা ও ইমিগ্রেশন পদ্ধতি সহজতর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা; পর্যটনের সাথে সংযুক্ত খাতসমূহের সমিতিসমূহ- যেমন, বাস মালিক সমিতি, অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিক সমিতি, বোট মালিক সমিতি ইত্যাদিকে পর্যটক বান্ধব করার জন্য এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় এনে তদারকি কর্তৃপক্ষ গঠন করা; কার্যকর কমিউনিটি অংশগ্রহণের মাধ্যম প্রকৃতি ও নৃতাত্ত্বিকভিত্তিক এবং দারিদ্রবান্ধব পর্যটন যেমন- কমিউনিটি পর্যটন, ইকো পর্যটন, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন, জৈব কৃষি পর্যটন ও সাংস্কৃতিক পর্যটনকে উৎসাহিত করার জন্য সৃজনশীল ও অভিনব কার্যক্রম গ্রহণ; আর্থিক স্বচ্ছলতা ও ক্ষমতায়ন করার জন্য নারী জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্তকরণ করা; পর্যটন শিল্পে মানব সম্পদ উন্নয়ন, পর্যটন কার্যক্রমের মাধ্যমে পরিশোধন বিবরণী, নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি, দারিদ্র দূরীকরণ ও সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ; কমিউনিটি পর্যটন, ইকো পর্যটন, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের বিকাশ ঘটানোর জন্য উদ্যোক্তাদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার ঘূর্ণায়মান তহবিল (রিভলভিং ফান্ড) গঠন করা; ব্যাংকিং লিঙ্কেজ স্থাপন।

শিজক: সরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহ এই শিল্পবিকাশে কতটুকু এগিয়ে এসেছে কিংবা তাদের এগিয়ে আসা উচিত মনে করেন কীনা?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: অবশ্যই। আগেই বলেছি, সরকার হলো এ সেক্টরের মূলশক্তি ও উৎস। পৃথিবীর যত দেশে পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়েছে তার সম্মুখভাগে থেকে সরকার নেতৃত্ব দিয়েছে, সমন্বয় করেছে, সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে, উদ্যোক্তা তৈরী ও প্রণোদিত করেছে এবং ঘূর্ণায়মান তববিল সৃষ্টি করেছে। তাই এক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগ আরও সমন্বিত, বৃহৎ, তাৎপর্যপূর্ণ, গভীর, কার্যকর ও ফলপ্রসূ হওয়াটাই প্রত্যাশিত।

শিজক: রাঙামাটিকে তুলে ধরার জন্য খাতসংশ্লিষ্টরা কী কী ভূমিকা রেখেছে এত দিনে?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: আমরা একথা তো স্বীকার করতেই হবে যে, প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলেও রাঙামাটির পর্যটন খাত আগের চাইতে এগিয়েছে। যেহেতু এটি সমন্বিত উদ্যোগ, তাই খাতসংশ্লিষ্টদের অবদানতো অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা খুব বেশি প্রণিধানযোগ্য নয়। প্রথাগত পর্যটন বিকাশে বেসরকারী উদ্যোগে শহরকেন্দ্রিক অনেকগুলো হোটেল ও মোটেল হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ও তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে রিসোর্ট উন্নয়নে। শহর এলাকার বাইরে হ্রদ ও পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বেশকিছু রিসোর্ট ও ইকো রিসোর্ট। স্থানীয় উদ্যোক্তারা নিজেদের এলাকা, মানুষ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে ভালোবেসে এসকল রিসোর্ট গড়ে তুলেছে এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য গড়ে তুলেছে ‘রাঙামাটি রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’।

শিজক: রাঙামাটির সিম্বল হিসেবে পরিচিত পর্যটন সেতুটি কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়লেই ডুবে যায়; এটি পর্যটনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে কি?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে খুবই মনোরম ও আকর্ষণীয় স্থানে সেতুটি অবস্থিত বলে সারাদেশে পর্যটন সেতুটি জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি বেড়ে গেছে। তাই রাঙ্গামাটির প্রথাগত পর্যটনের আইকনে পরিণত হয়েছে এ সেতুটি এবং পরিচিতি পেয়েছে ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’ হিসেবে। কিন্তু নির্মাণের সময় কাপ্তাই হ্রদের ধারণ ক্ষমতা ও উচ্চতা বিবেচনা করা হয়নি বলে হ্রদের ধারণ ক্ষমতার কাছাকাছি আসলেই সেতুটি ডুবে যায়। ডুবন্ত সেতু তাদের আর আকর্ষণ করে না। অর্থাৎ সেতুটি পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে নির্মিত হয়নি। ফলে রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনে ভ্রমণকারীরা যায় না এবং রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক মোটেলগুলো পর্যটকশূণ্য থাকে। এ বিষয়টি আমাদের একটি তাৎপর্যপূর্ণপ বার্তা দেয়। অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে নির্মাণ করায় একটু পানি বাড়লেই ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’ ডুবে যায়। ঠিক তেমনি, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তঃবিভাগীয় সুসমন্বয় ও সুপরিকল্পনার অভাবে রাঙামাটির অমিত সম্ভাবনার পর্যটন শিল্প ডুবে আছে। সম-সাময়িক প্রবণতায় চলছে পর্যটন শিল্প।

শিজক: পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী পর্যটনশিল্প পার্বত্য জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত বিভাগ; এই সেক্টরের উন্নয়নে জেলা পরিষদকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট হতে পর্যটনশিল্প রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত হয়। পার্বত্য চুক্তির সরাসরি আউটকাম হিসেবে স্থানীয় পর্যটন শিল্প জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত হওয়ায় স্থানীয় উদ্যোক্তা ও জনগোষ্ঠির প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। পর্যটনের জন্য বিশেষ অঞ্চল ঘোষণার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এর গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী বিশেষ অঞ্চলের জন্য কিছু বৈশিষ্ট্য স্থির করে দিয়েছেন। যেমন: প্রাকৃতিক এবং নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্যসমূহ; প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান/ নমুনা; ঐতিহাসিক স্থানসমূহ; বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য; পাহাড়, গুহা, জলপ্রপাত; লেক, জলাভূমি (হাওর-বাঁওড়), দীঘি ও জলাশয়; গণ উৎসব ও সাংস্কৃতিক পার্বণ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনধারা; সমুদ্রতট, নদী সঙ্গম, উপকূলীয় এলাকা, দ্বীপ ও বালিয়াড়ি; এমন এলাকা যা সরকারের কাছে স্বিশেষ বৈশিষ্ট্যের স্থান, কাঠামো ও পণ্য বলে মনে হবে। উপরের সব বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় রাঙামাটিকে পর্যটনের জন্য একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

কিন্তু গত ৯ বছরে এ খাতে জেলা পরিষদ প্রণিধানযোগ্য, গুণগত, তাৎপর্যপূর্ণ, সমন্বিত ও দৃশ্যমান অগ্রগতির আরও অনেক সুযোগ ছিল। আমরা আশাকরছি ও বিশ্বাস করছি যে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ জনপ্রত্যাশা মেটাতে এবং কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বকে আরও গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে উপলব্ধি করে কার্যকর ও লক্ষ্যভেদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন এবং বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবেন।

শিজক: অর্থনৈতিক বা স্থানীয়দের কর্মসংস্থানে পর্যটন শিল্প কতটুকু ভূমিকা রাখছে কিংবা রাখতে পারবে?

মোহাম্মদ ওমর ফারুক: পর্যটন শিল্প খাত কি একটি বহুমাত্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির খাত হিসেবে বিবেচ্য। শিল্প-কলকারখানা বিহীন রাঙামাটি অঞ্চলে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকরন একটি অগ্রাধিকার ইস্যু। পর্যটন শিল্প খাতের বিকাশ সাধিত হলে বেকার যুব থেকে শুরু করে দোকানদার, হোটেল মালিক, পরিবহন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি, স্থিতিশীলতা, সম্প্রীতি ও অগ্রগতি সহ শিল্পায়নের প্রাথমিক হাব হিসেবে পর্যটন খাতকে প্রাধান্য দিয়ে পর্যটন বিকাশের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কমিউনিটি পর্যটন, ইকো পর্যটন, অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন ও সাংস্কৃতিক পর্যটন বিকাশের অবারিত সুযোগের কিছু অংশও কাজে লাগানো গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক ও স্থিতিশীল রাজনীতির ব্যাপকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।

সম্পর্কিত খবর

সোশ্যাল মিডিয়া

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ খবর